চলচ্চিত্র সমালোচনা » বরের আশায় বন্দনা : অস্কারের টোপে ‘ইডা’
বরের আশায় বন্দনা : অস্কারের টোপে ‘ইডা’
সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে
কহিল কবির স্ত্রী ...
গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব ...
মাথা ও মুণ্ড, ছাই ও ভস্ম,
মিলিবে কি তাহে হস্তী অশ্ব
না মিলে শস্যকণা। ...
ওগো, ফেলে দাও পুঁথি ও লেখনী,
যা করিতে হয় করহ এখনি।
এতো শিখিয়াছ এটুকু শেখ নি
কিসে কড়ি আসে দুটো!’ ...
উচাটন কবি কহিল, ‘অমন
যেয়ো না হৃদয় দলি।
ধরা না দিলে ধরিব দু পায়,
ঘর ভরি দিব সোনায় রুপায় ...
বুদ্ধি জাগাও তুমি।১
সন্দেহ থেকে শুরু
ছোটোবেলায় দেখতাম (৯০-এর দশকের শেষের দিকে) ভ্যানের উপর দোচালা করে সাজানো কাঠে পোস্টার লাগিয়ে প্রেক্ষাগৃহে চলা চলচ্চিত্রের প্রচার চালাতেন এক ব্যক্তি। এ সময় জনপ্রিয় কোনো গানের ফাঁকে চলচ্চিত্রের ফিরিস্তি দিয়ে তিনি দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে আসার আমন্ত্রণ জানাতেন। নায়ক, নায়িকা, খলঅভিনেতার পরিচয়ের পাশাপাশি অল্পবিস্তর কাহিনি জানিয়ে, তিনি চেষ্টা করতেন দর্শক টানার। সপ্তাহান্তে নতুন চলচ্চিত্রের মুক্তিতে প্রচারে পরিবর্তন আসতো। তবে প্রচারের নির্দিষ্ট সেই ঢঙের সঙ্গে অপরিবর্তিত থেকে যেতো কিছু কথা। প্রচারের ভ্যানে থাকা ওই ব্যক্তি সবসময় দর্শককে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে কথা শুরু করতেন; প্রেক্ষাগৃহের নাম জানিয়ে আমন্ত্রণ জানাতেন সেখানে আসার; আর চলচ্চিত্রটি যে রঙিন রুপালি পর্দায় দেখানো হবে, সেটা জানাতে তিনি কখনোই ভুলতেন না।
প্রেক্ষাগৃহে দর্শক টানতেই যে রঙিন শব্দটা তিনি বার বার ব্যবহার করতেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর আগে ৬০-এর দশকেও দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে টানতে নির্মাণ করা হয় আংশিক রঙিন চলচ্চিত্র। সেসময়ে নির্মিত সাদা-কালো চলচ্চিত্র ৮০’র দশকে এসে পুনর্নির্মাণ করে নাম রাখা হয় রঙিন রূপবান (১৯৮৫), রঙিন জরিনা সুন্দরী (১৯৮৭), রঙিন কাঞ্চনমালা (১৯৮৮) ইত্যাদি। এসব চলচ্চিত্রের সঙ্গে ৬০-এর দশকের ওই সব চলচ্চিত্রের পার্থক্য কেবল সাদা-কালো আর রঙিনে।
প্রযুক্তির বদৌলতে আজকের দিনে সাদা-কালো, রঙিন কোনো বিষয় না হলেও উন্নতমানের ডিজিটাল ক্যামেরায় দৃশ্য ধারণ ও প্রক্ষেপণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর ব্যতিক্রম যে একেবারেই নেই, তা কিন্তু নয়। বর্তমান সময়েও হাঙ্গেরির চলচ্চিত্রনির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার লাজলো নেমেস কিন্তু ১৬ ও ৩৫ মিলিমিটার ফিল্ম ক্যামেরায় একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, চলচ্চিত্র পরিচালনা বোঝার জন্য ফিল্ম ক্যামেরায় কাজ করা জরুরি। তাছাড়া অভিনয়শিল্পীর কাছ থেকে নির্দিষ্ট চরিত্রে অভিনয় বের করে আনতেও ফিল্ম ক্যামেরার বিকল্প কম।২
একইভাবে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন চলচ্চিত্রনির্মাতা অ্যালান ক্রসল্যান্ডের হাত ধরে দ্য জ্যাজ সিঙ্গার-এর মাধ্যমে সবাক চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হলেও সে পথে পা বাড়াননি চলচ্চিত্রের মহাপুরুষ চার্লি চ্যাপলিন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে এসে তিনি নির্মাণ করেন নির্বাক সিটি লাইটস। তিনি মনে করতেন, সবাক চলচ্চিত্রের আবির্ভাব ঘটলেও নির্বাকের দিন শেষ হয়ে যায়নি। সেসময় চলচ্চিত্র সমালোচকরাও নির্বাকের অনন্যতাকে উত্তম ভাবতো। বরং চলচ্চিত্রে শব্দের আগমনকেই পিছিয়ে যাওয়া বলে মনে করে অনেকে। চার্লি হয়তো বিশ্বাস করতেন, শিল্পের আলাদা কোনো ভাষা নেই। চলচ্চিত্রের ভাষা আন্তর্জাতিক মেনেই হয়তো তিনি নির্দিষ্ট কোনো ভাষার গণ্ডিতে তার চলচ্চিত্রকে আবদ্ধ করতে চাননি।
কিন্তু ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে এসে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকতেও সাদা-কালো ইডা নির্মাণের মধ্য দিয়ে নতুন করে ভাবনার উদ্রেক করেন পোল্যান্ডের চলচ্চিত্রনির্মাতা পাউয়েল পাউলিকোস্কি। নির্মাণের পর পরই সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ইডা ইউরোপিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, ইউরোপিয়ান ফিল্ম অ্যাকাডেমি পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড, কান, টরেন্টো, বাফটাসহ নানা পুরস্কার পেতে থাকে। এমনকি ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের অস্কারে বিদেশি ভাষার সেরা চলচ্চিত্রের মুকুট ছিনিয়ে নেয় ৮২ মিনিটের সাদা-কালো ইডা।
সাদা-কালো চলচ্চিত্রটির এতো এতো পুরস্কার প্রাপ্তির পর তাই সন্দেহ জাগে, পুরস্কারের এই আশাতেই নির্মাতা পাউলিকোস্কি চলচ্চিত্রের আধেয় নির্মাণ করেননি তো? ‘সাদামাট’ প্রচেষ্টার পিছনে তার ভিন্ন কোনো রাজনীতি থাকলেও থাকতে পারে। কারণ যারা যতো কথাই বলুন না কেনো, পুরস্কারের পিছনে তো একটা অলিখিত শর্ত থাকে। আর সেই পুরস্কার অস্কার হওয়াতে সন্দেহটা আরো প্রকট হয়। সাধারণ দর্শকের কাছে চলচ্চিত্রটি যে রকমই হোক না কেনো, অস্কার পাওয়ার পিছনে নির্মাতা পাউলিকোস্কি’কে কোনো অলিখিত শর্ত মানতে হয়েছে কি না তা বোঝার জন্য ইডার বিশ্লেষণ জরুরি মনে করছি।
শিল্প ও নির্মাতা সমাচার
নির্মাতা পাউয়েল পাউলিকোস্কির জন্ম পোল্যান্ডের ওয়ারশ’তে, ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে পোল্যান্ড ছেড়ে মায়ের সঙ্গে জার্মানিতে চলে যান তিনি। তার মা খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী হলেও বাবা ছিলেন ইহুদি। কিন্তু মায়ের সঙ্গে বেড়ে উঠায় পাউলিকোস্কি ধীরে ধীরে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী হয়ে ওঠেন। ছেলে খ্রিস্টান ধর্মের দিকে ঝুঁকছে দেখে ভীষণভাবে মনঃক্ষুণ্ন হন তার ইহুদি বাবা। শেষবারের দেখায় তাই হয়তো ছেলের কাছে বাবা আবদার করেছিলেন, পরিণত বয়সে তিনি যেনো পোল্যান্ডের ইতিহাস এবং ইহুদিদের প্রতি অসম্মান না করেন।
বাবার সেই আবদার দাগ কেটেছিলো পাউলিকোস্কির মনে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্মান সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে ব্রিটিশ টেলিভিশনে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। তার প্রথম চলচ্চিত্র দ্য স্ট্রিঙগার মুক্তি পায় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে। তবে লাস্ট রিসোর্ট (২০০০) দিয়ে তিনি আলোচনায় আসেন। এর পর ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে মাই সামার অব লাভ ও দ্য উইম্যান ইন দ্য ফিফথ (২০১১) নির্মাণ করেন তিনি। তবে স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় ২০০৬ থেকে ২০১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাউলিকোস্কি চলচ্চিত্রে সেভাবে নিয়মিত থাকতে পারেননি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর দ্য উইম্যান ইন দ্য ফিফথ নির্মাণের মধ্য দিয়ে তিনি আবার নিয়মিত হন।
চরম ব্যস্ততার মধ্যেও বাবাকে দেওয়া কথা রাখতেই পাউলিকোস্কি ফিরে যান জন্মভূমি পোল্যান্ডে। ভাবতে থাকেন বাবা তথা ইহুদিদের সম্মানে কিছু করার বিষয়ে। সেই চিন্তা এবং শৈশবে পোল্যান্ডে কাটানো ১৪ বছরের স্মৃতির ঝুলি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের বিচরণক্ষেত্র চলচ্চিত্রে তা তুলে ধরার কথা তিনি ভাবতে থাকেন। শুরু হয় ইডার কাজ। ইডা (২০১৩) পাউলিকোস্কি’র পোল্যান্ডে নির্মাণ করা প্রথম চলচ্চিত্র।
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডে গির্জার আশ্রমে বেড়ে উঠা আন্নাকে ঘিরে ইডার কাহিনি। নান হিসেবে শপথ নেওয়ার আগ মুহূর্তে তার একমাত্র জীবিত আত্মীয় খালা উয়ান্ডার সঙ্গে দেখা করতে যান তিনি। খালার কাছেই জানতে পারেন, তার নাম আসলে ইডা লেবেনেস্টেইন। তার ইহুদি মা-বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত হয়েছেন। নিহত মা-বাবার স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো দেখার জন্য খালার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন আন্না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত আন্নার পরিবারের বসবাস করা বাড়ি এখন খ্রিস্টান ফেলিসের দখলে। আন্নার পরিবারকে ফেলিস হত্যাও করেছে ।
ফেলিসের সঙ্গে দেখা হলে বাড়ির অধিকার ছেড়ে দেওয়ার শর্তে আন্নাকে তার মা-বাবার সমাধিস্থল দেখাতে রাজি হন তিনি। ফেলিস এক জঙ্গল থেকে মাটি খুঁড়ে আন্নার মা-বাবার মাথার খুলি তুলে দেন। ইতোমধ্যে আন্নাকে গির্জার আশ্রম ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য বার বার আহ্বান জানান উয়ান্ডা। অথচ আন্নার সঙ্গে জঙ্গল থেকে ফিরে আসার পর একদিন জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে উয়ান্ডা আত্মহত্যা করেন। গির্জার আশ্রমের নিয়ম মেনে চলা আন্না এবার উয়ান্ডার স্থলাভিষিক্ত হন। উয়ান্ডার মতো তিনিও সিগারেট, মদ্যপান আর বারে যাওয়া শুরু করেন। খুলে ফেলেন গির্জার পোশাক; যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন স্যাক্সোফোন বাদক লিস-এর সঙ্গে। শেষমেষ গির্জায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আন্না।
আকর্ষণীয় মোড়কে ইডার উপস্থাপন
আফ্রিকান-আমেরিকান বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ নির্মাতা স্পাইক লি মনে করেন, চলচ্চিত্র শুরুর দৃশ্যের ওপর নির্ভর করে পরের দু -আড়াই ঘণ্টা দর্শক সেটা কীভাবে গ্রহণ করবে। এ কারণে শুরুর দৃশ্যটার প্রতি বাড়তি নজর দেন তিনি; চেষ্টা করেন শুরুতেই সৃজনশীল কিছু উপস্থাপনের।৩ সেই দিক বিবেচনায় পাউলিকোস্কি’র ইডা বেশ সফল। এর শুরুর দৃশ্যেই (ওপেনিং ক্রেডিট সিকোয়েন্স) দর্শক হিসেবে হোঁচট খেতে হয় (ইতিবাচক অর্থে)। খুব সচেতনভাবে খেয়াল না করলে মনে হতে পারে, একজন নারী অত্যন্ত মনোযোগের সহিত তার পুরুষ সঙ্গীকে আলিঙ্গনের চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগে না; আন্নাকে দেখা যায় যিশু খ্রিস্টের মূর্তিতে রঙ লাগাতে। এর পরেই লো অ্যাঙ্গেল শটে একই তালে চার জন নারীকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবে মনে হতেই পারে এই চারজন নারী একে অন্যের গলা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই বোঝা যায়, কাঁধে যিশু খ্রিস্টের মূর্তি থাকায় তাদের হাঁটতে হচ্ছে ওইভাবে। ভুল ভেঙে যাওয়ার পর দর্শক হিসেবে আরেকবার চমকে যেতে হয়; এই চমক চলচ্চিত্রটির প্রতি আকর্ষণ বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
সবচেয়ে মজার বিষয় চলচ্চিত্রের কোথাও কেবল বাস্তবতা দেখানো হয় না। এর বিপরীতে দর্শককে চিন্তা করার সুযোগ দিয়েছেন পাউলিকোস্কি। নির্মাতা হিসেবে তিনি বাস্তবের অনুভূতি তুলে ধরেছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। উয়ান্ডা কিংবা আন্নাও যখন যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন, দর্শক সেটা চাক্ষুস করেনি ঠিকই; কিন্তু বিষয়টি বুঝতে কারোরই বেগ পেতে হয় না। একইভাবে, ফেলিস যখন গর্তের মধ্যে বসে আন্নার মা-বাবা এমনকি উয়ান্ডার ছেলেকে হত্যার নির্মম কাহিনির বর্ণনা করছিলেন, সেটাও পর্দায় দেখান না পাউলিকোস্কি। দর্শককে ভাবার অবকাশ দিয়েছেন¾উয়ান্ডার ছেলে কিংবা আন্নার পরিবারকে হত্যার দৃশ্য কতোটা নির্মম হতে পারে। কারণ এইসব দৃশ্য ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হলে, দর্শক আর সেভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারতো না। আর যে নির্মমতা তারা চাক্ষুস করতো, যে নির্মম দৃশ্যের ইমেজ তাদের চোখে ভাসতো, কল্পনায় ঘুরেফিরে সেটাই আসতো; দর্শকের পক্ষে সেটা অতিক্রম করা হয়তো সম্ভব হতো না।
২০১৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মাতা লাজলো নেমেসও হলোকাস্ট নিয়ে নির্মিত সন অব সাউল-এ বাস্তবতা সেভাবে তুলে ধরেননি। গল্পের জন্য অপরিহার্য বিষয়াদি ছাড়া বাকি সব বর্জন করেন তিনি। হলোকাস্টের ঐতিহাসিক বিষয়াদি উপস্থাপনের পরিবর্তে একজন মানুষের গল্পের মধ্য দিয়ে তার মিশন তুলে ধরেছেন। ফলে অন্যসব চলচ্চিত্রে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মানুষ মারার দৃশ্যের দিকে ঝোঁক দেখা গেলেও সন অব সাউল-এ সেসব নেই। গ্যাস চেম্বারের সামনে গিয়ে ক্যামেরা থেমে যেতে দেখা যায়। এতে করে গ্যাস চেম্বারের ভিতর মানুষ মারার বিষয়টি দমবন্ধভাবে দর্শক যেভাবে কল্পনা করতে পারে, দৃশ্যটা দেখানো হলে তা হয়তো সম্ভব হতো না। একইভাবে ইডাতেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো দৃশ্য সরাসরি হাজির নেই। অথচ চলচ্চিত্রে যুদ্ধ হাজির থেকেছে অনেকটা সময়জুড়ে। আর সেখানেই নির্মাতা হিসেবে পাউলিকোস্কি’র স্বার্থকতা।
চলচ্চিত্রের আরো দুটি বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত ভালো লেগেছে। প্রথমত, গাড়ি চলার সময় কাউকে হর্ন বাজাতে দেখা যায়নি। গাড়ির দরজা খুলে ওঠানামা কিংবা বসার সময়ও শব্দ রাখেননি পাউলিকোস্কি। হয়তো বাস্তবের অনুকরণ করতে চাননি বলে সেগুলো এড়িয়ে গেছেন। এছাড়া চলচ্চিত্রের বেশিরভাগ দৃশ্য একই অ্যাঙ্গেল থেকে শট্ নেওয়া হয়েছে। শট্ বিভাজন করে দর্শকের চোখের ওপর হয়তো কোনো চাপ সৃষ্টি করতে চাননি তিনি। তাছাড়া বেশিরভাগ দৃশ্যেই আকাশ দেখা গেছে। গভীরভাবে ভাবলে চরিত্রগুলোকে দেখা যায় আকাশের সঙ্গে মিশে যেতে। আন্না কিংবা উয়ান্ডাও তাদের সবকিছুই হারিয়েছেন। সেক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের কোনো দৃশ্যের ফ্রেমজুড়ে বিস্তীর্ণ আকাশের উপস্থিতি কিংবা আরো নির্দিষ্ট করে বললে, আকাশের সঙ্গে তাদের হারিয়ে/মিশে যাওয়াটা বেশ মানানসই বলেই মনে হয়।
আধেয় নির্মাণের নেপথ্যে কোষ্ঠি বিচার
শিল্পের জন্য শিল্প, নাকি পুরস্কারের ...
ইডা নির্মাণের পর নির্মাতা পাউলিকোস্কি মন্তব্য করেছিলেন, চলচ্চিত্রটি আমি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মাণ করিনি; উৎসবকে টার্গেট করেও করিনি। কারণ আমি জানি, পোল্যান্ডের একটি চলচ্চিত্রের পক্ষে কান, ভেনিস কিংবা বার্লিনের উৎসবে পুরস্কার পাওয়া কতোটা কঠিন! এমনকি যখন আমি আমার বন্ধুদের বলি চলচ্চিত্রটি পোল্যান্ডে নির্মাণ করেছি, সেটাও আবার সাদা-কালো; তখন তারা মশকরা করে আমার চলচ্চিত্রকে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের হারাকিরির সঙ্গে তুলনা করে।৪
ইডা সম্পর্কে এখানে পাঁচটি বিষয়ে কথা বলেছেন নির্মাতা। প্রথমত, চলচ্চিত্রটিতে বাণিজ্যিক উপাদান রাখেননি; দ্বিতীয়ত, উৎসবের জন্য এটি নয়। তৃতীয়ত, এটি সাদা-কালো চলচ্চিত্র। চতুর্থত, ইডা নিয়ে তিনি বন্ধুমহলে হাসিতামাশার শিকার হয়েছেন। আর পঞ্চম বিষয়টি ওই চারটি বিষয়ের মধ্যেই লুকানো আছে (তার মানে ইডার আধেয়)।
এবার পাউলিকোস্কি’র কথাগুলোর সত্যতা যাচাই করে দেখা যাক। দ্বিতীয় বিষয় ধরে আলোচনা করলে প্রথমটির উত্তর আপনা-আপনিই চলে আসবে। ইডা যে উৎসবে পাঠানোর জন্য নির্মাণ করেননি কিংবা উৎসবে পাঠানোর উপযোগী নয়¾পাউলিকোস্কি’র এই যুক্তি রীতিমতো হাস্যকর। কারণ ইতোমধ্যে চলচ্চিত্রটি ৮৩টি স্থানে পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়ে ৬৭টি পুরস্কার জিতেছে। এর মধ্যে অস্কারে বিদেশি ভাষার সেরা চলচ্চিত্রসহ ভেনিস, বার্লিন, বাফটা, টরেন্টো, কান, ইউরোপিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডও রয়েছে। সুতরাং চতুর্থ অপশন মানে বন্ধুমহলে হাসিতামাশার আর কোনো ব্যাপার থাকার কথা নয়।
আর পুরস্কার জেতার পর যেকোনো চলচ্চিত্রের ব্যবসা বহুগুণে বেড়ে যায়। ইডার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ২ আগস্ট ২০১৪ পর্যন্ত চার মিলিয়ন ডলার আয় করলেও অস্কার জেতার পর ইডার আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১.১-এ। সেক্ষেত্রে চলচ্চিত্রটি ব্যবসার জন্য নির্মাণ করা হয়নি, সেই যুক্তিও আর টিকে না। তাহলে সাদা-কালো ইডার আধেয়ে কী আছে তা বিশ্লেষণ করা জরুরি (যেটা পঞ্চম উক্তি)। তার আগে ইডার পাওয়া সবচেয়ে দামি পুরস্কার, মানে অস্কার আসলে কীসের ভিত্তিতে দেওয়া হয়, সে বিষয়ে একটু জানা দরকার বলে মনে করছি।
৮৯তম আসর পর্যন্ত অস্কারে মনোনয়ন পাওয়া থেকে শুরু করে পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের আধেয় বিশ্লেষণ করলে ইতিহাসভিত্তিক, যুদ্ধকেন্দ্রিক ও জীবনীনির্ভর কাহিনিই বেশি পাওয়া যায়। তাছাড়া সেই কাহিনির মধ্যে আবার রাজনৈতিক কূটচালও থাকে। আর সেই চালে সচরাচর শ্বেতাঙ্গদের ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে দেখা যায়। ইডাতে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তা ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের পোল্যান্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে গড়ে উঠেছে এর কাহিনি। আর কাহিনির মধ্যে যুদ্ধাপরাধ, স্তালিন বিরোধিতা, ইহুদিদের একপেশেভাবে মহান করে তোলার পাশাপাশি খ্রিস্টানদের হেয় করার প্রবণতা তো আছেই। তাহলে পাউলিকোস্কি কি সেই একই ধারার চলচ্চিত্র বানিয়েছেন অস্কারকে টার্গেট করে?
কারণ অস্কার সচরাচর শ্বেতাঙ্গদের দেওয়া হয়। ফলে ইডাতে শ্বেতাঙ্গদেরই রাখলেন তিনি। আবার সব ভালো চরিত্রে রাখলেন ইহুদি আর খারাপ সব খ্রিস্টানদের; সঙ্গে টোপ হিসেবে গেঁথে দিলেন স্তালিন, যুদ্ধাপরাধ আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রসঙ্গ। কারণ অস্কার কমিটি সচরাচর নির্দিষ্ট একটা ঘরানার মধ্যে থেকেই পুরস্কার প্রদান করে। স্বাভাবিকভাবেই অস্কার কমিটির পছন্দের ফ্রেমের সঙ্গে মিলেই আর্জেন্টিনার ওয়াইল্ড টলস, মৌরিতানিয়ার তিম্বুকটু, ইস্তোনিয়ার টেঞ্জারিনস, রাশিয়ার লেভিয়েশান-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছে যুদ্ধভিত্তিক ইডা।
কিন্তু অস্কার কর্তৃপক্ষ ইডাকেই কেনো বেছে নিলেন, সে ব্যাপারেও পরিষ্কার হওয়া দরকার। সবসময় কি পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রটি উপযুক্ত থাকে, নাকি নির্দিষ্ট কোনো কারণে অস্কার ধরিয়ে দেওয়া হয়? সাম্প্রতিক কয়েক বছরের অস্কার নিয়ে জানা থাকলে বিষয়টি বুঝতে আর পিছন ফিরে যেতে হবে না।
কালো মানুষদের অধিকার নিয়ে কথা বলা আফ্রিকান-আমেরিকান নির্মাতা স্পাইক লি ৮৮তম অস্কার অনুষ্ঠান (২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত) বর্জন করেন। তার অভিযোগ ছিলো, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের মতো সে বারেও অস্কারে ইচ্ছাকৃতভাবে শ্বেতাঙ্গদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তার এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসে অস্কার কর্তৃপক্ষ। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে এসে তারা প্রথমবারের মতো কোনো মুসলিমের হাতে অস্কার তুলে দেয়। মুনলাইট-এ কৃষ্ণাঙ্গ এক মাদক বিক্রেতার ভূমিকায় অভিনয় করে সহ-অভিনেতার অস্কার জিতেন মহেরশালা আলি। বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির অংশ হিসেবেই এই পুরস্কার ওঠে মুসলমানের হাতে। তাছাড়া আগের বছরে কৃষ্ণাঙ্গ ইস্যু নিয়ে কেলেঙ্কারি মুছে ফেলতেই হয়তো তারা এ মুসলিমকে বেছে নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যখন কোনো বড়ো ধরনের সঙ্কট, বিরোধ, উত্তেজনা তৈরি হয়, সেটার প্রভাব সবসময় চলচ্চিত্র সংক্রান্ত নানা বিষয়ের ওপর পড়ে। মুসলমান মহেরশালা আলির হাতে অস্কার তুলে দেওয়া, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসী ও মুসলিমবিরোধী নানা বক্তব্য, পদক্ষেপের কারণে বিশ্বজুড়ে সৃষ্ট অস্বস্তির মধ্যে আমেরিকাকে হয়তো কিছুটা স্বস্তি দেয়। কিন্তু ইডাকে কেনো অস্কার দেওয়া হলো সেই রাজনীতিটা পরিষ্কারভাবে জানার জন্য আরো কিছু বিষয়ে জানা দরকার।
পক্ষপাতদুষ্ট মানবিকতা
এ কেমন বিচার!
চলতি মুসলমানি ডিসকোর্সে যেমন নেতিবাচকভাবে দাড়ি-টুপির উপস্থাপন লক্ষ করা যায়; একইভাবে ইডাতেও ইহুদিদের বাইরে অন্যদের বেলায় দেখা যায় সেরকম উপস্থাপন। গির্জার আশ্রমে খাবারের সময়ও নানদের সম্মতির প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়াদিতে তারা কতোটা কড়া নজরদারির ভিতর দিয়ে যান তা আর বলার প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া আশ্রমের অন্যরা যেহেতু নানদের কথায় ওঠে-বসে, বাইরের জগৎ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান খুবই সীমিত হয়ে পড়ে। এতে করে ইডায় গির্জার উপস্থাপন হয়ে যায় সেকেলে, পিছিয়ে পড়া।
ইহুদিদের বাইরে ইডায় যে লোকজন আছে, তার মধ্যে অন্যতম আন্নার পরিবারের হত্যাকারী ফেলিস। প্রথম দর্শনেই স্বাভাবিকভাবে যে কেউ তার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করবে। কারণ সিগারেট হাতে ভ্রু কুঁচকে আড়চোখে যেভাবে তিনি উয়ান্ডার দিকে তাকিয়ে থাকেন, সেটা যে কারো চোখে পড়বে। উয়ান্ডা তাদের ফেলে আসা বাড়িটার একটা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলে পথ আগলে দাঁড়ান ফেলিস। এ সময় ভস করে উয়ান্ডার মুখের দিকে তিনি সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে থাকেন। একপর্যায়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকতে হয় উয়ান্ডাকে। এভাবে প্রথম দর্শনেই ফেলিসকে খারাপ মানুষ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন পাউলিকোস্কি।
এরপর ফেলিসের বাবার কাছে আন্নার পরিবারকে হত্যার বিষয়ে জানতে হাসপাতালে যান উয়ান্ডা। এ সময় আন্না তার সঙ্গেই ছিলেন। উয়ান্ডাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেন বৃদ্ধ। তার পরও অসুস্থ ওই বৃদ্ধের কাছে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে উয়ান্ডা বার বার জানতে চান। বোঝা যায়, বৃদ্ধ পাপবোধে ভুগছেন। পাপবোধ থেকেই হয়তো আন্নার উদ্দেশে বলে ওঠেন, খুব ভালো মানুষ ছিলো তোমার বাবা। এর বেশি জানতে চাইলে নিশ্চুপ বৃদ্ধের শ্বাসপ্রশ্বাস বহুগুণে বাড়তে থাকে।
উয়ান্ডা এবার তার ছেলের কথা জানতে চান; কিন্তু বৃদ্ধের মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হয় না। উয়ান্ডা বুঝতে পারেন, তার ছোট্ট ছেলেটাকে হত্যা করা হয়েছে। দর্শক হিসেবে যে কারো মনে হতেই পারে, ছেলের হত্যাকারীকে কাছে পেয়ে এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বেন উয়ান্ডা; নিভিয়ে দেবেন ছেলের হত্যাকারীর জীবন প্রদীপ। কিন্তু এসবের পরিবর্তে উয়ান্ডা মানবিকতার প্রশ্ন তোলেন। জানতে চান হত্যার সময় সে খুব ভয় পেয়েছিলো কি না। বৃদ্ধ এবার জিজ্ঞেস করেন, কে? কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে কণ্ঠে জড়তা নিয়ে উয়ান্ডা জানান, তার ছেলে। আবার চুপ করে থাকেন বৃদ্ধ। উয়ান্ডার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘আপনি কীভাবে এ কাজ করতে পারলেন একজন শিশুর সঙ্গে!’ তার এই মানবিকতা দেখে ‘মানবিক’ যুক্তরাষ্ট্রের কথা মনে পড়ে যায়। সন্দেহ ঘনীভূত হয়, প্রভুদের খুশি করতেই নির্মাতা পাউলিকোস্কি’র উপস্থাপন এ রকম হয়নি তো?
তাছাড়া এতোগুলো বছর পরে এসে ইহুদি-বিদ্বেষী একজনের মুখ দিয়ে ইহুদিদেরই প্রশংসা করা দেখান পাউলিকোস্কি। ইহুদিরা যে ভালো, সেটা বোঝাতে এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে! যদিও চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দৃশ্যে ইহুদিদের ইতিবাচক উপস্থাপনের পাশাপাশি নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়েছে অন্যদের।
খালাকে নিয়ে আন্না হাসপাতাল থেকে ফিরে যাওয়ার পর একদিন উয়ান্ডার বাড়িতে আসেন ফেলিস। আন্নার সঙ্গে দেখা করে জানান, তার মা-বাবাকে হত্যার পর পুঁতে রাখার স্থান দেখাতে তিনি রাজি। তবে শর্ত জুড়ে দেন, আন্না আর তার বাড়িঘরের দাবি করতে পারবেন না। এতে রাজি হন আন্না। এখানে খেয়াল করার বিষয় হলো, ফেলিসের স্বার্থপরতা। যিনি দুটো মানুষকে হত্যা করে দীর্ঘদিন তাদের বাড়িঘর, সম্পদ দখলে রাখার পর তাদেরই সন্তানকে সম্পদের দাবি ছেড়ে দেওয়ার শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। অথচ আন্নারা কতো ভালো, উদার; কেবল মা-বাবার দেহাবশেষ পুঁতে রাখার স্থানটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ; সম্পদ তাদের কাছে একেবারেই তুচ্ছ। অবশ্য আন্নারা যে ভালো, সে সাক্ষ্য ফেলিসও দেন। মা-বাবার মরদেহ পুঁতে রাখার স্থান দেখানোর পর আন্না যে আর সম্পদের দাবি করবেন না, সেটা ফেলিস বিশ্বাস করেন। তার মানে আন্নাদের ওপর তাদের বিশ্বাস আছে, আন্নারা সেই বিশ্বাস তৈরি করেছে; অন্যভাবে বললে আন্নাদের ওপর বিশ্বাস রাখা যায়।
সেই বিশ্বাসে আস্থা রেখে জঙ্গলে গিয়ে মাটি খুঁড়ে আন্নার মা-বাবার দেহাবশেষ তুলে দেন ফেলিস। গর্তের মধ্যে থাকা অবস্থায় বীভৎসভাবে তিনি উয়ান্ডার সন্তানকে হত্যার বর্ণনা দেন। দর্শকের আর বোঝার বাকি থাকে না, ফেলিসরা কতোটা নৃশংস! অবশ্য নিজের কৃতকর্মের জন্য ফেলিসকে অনুশোচনায় ভুগতেও দেখা যায়। আন্নাদের প্রতি ততোক্ষণে দর্শকমনে সহানুভূতি জন্মে গেছে। দর্শক আরো কষ্টের ভাগিদার হয়, যখন দেখা যায় ইহুদিদের সমাধিস্থলে ঢুকে দুজন নারী মাটি খুঁড়ে মাথার খুলি পুঁতে রাখার চেষ্টা করছে। যে নারীদের কাছে তাদের আপনজনদের সুষ্ঠুভাবে সৎকারের বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ধনসম্পদ নয়! এভাবেই ইডাতে নানা প্রসঙ্গে ইহুদিদের একপেশে ভালোভাবে উপস্থাপন করেন নির্মাতা!
প্রথম দর্শনেই ফেলিসকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন, তারপর স্বার্থপর এবং শেষাবধি নৃশংস খুনি হিসেবে দর্শকের সামনে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তার বাবাকেও খুনি বানিয়ে তার মুখ দিয়ে ইহুদি-বন্দনা শোনান নির্মাতা। অন্যদিকে উয়ান্ডাদের উপস্থাপন হয় বরাবরের মতোই উল্টো। ফেলিস যখন বীভৎসভাবে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন, তখনো নিশ্চুপ থাকেন আন্না। তাদের এই চুপ থাকার পিছনের মাহাত্ম্য কী? আন্না, উয়ান্ডারা কতো মহৎ; কী বিশাল তাদের মন! কারো মা-বাবা, কারো শিশু সন্তানকে হত্যা করা সত্ত্বেও ফেলিসকে টু কথাটা বলছেন না তারা। ক্ষমার চেয়ে বড়ো গুণ আর কীইবা হতে পারে! যে গুণ আন্নাদের আছে।
তাদের উদারতা অবশ্য চলচ্চিত্রজুড়েই দেখা যায়। চরম ব্যস্ততা আর ঝামেলা নিয়ে রাস্তায় চলার সময় দাঁড়িয়ে থাকা লিসের সামনে গাড়ি থামিয়ে লিফট দেন উয়ান্ডা। অত্যন্ত আন্তরিকতায় তার সঙ্গে কথা বলেন। অথচ খ্রিস্টান এক নারী তাদের সঙ্গে ভিন্ন আচরণ করেন। তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন সন্দেহের দৃষ্টিতে। স্বামী বাড়িতে না থাকায় পরবর্তী সময়ে আসার কথা বলেন। অথচ অপরিচিত কাউকে বাসায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে উয়ান্ডাকে এ রকম হীনমন্যতায় ভুগতে দেখা যায় না। ঘুম থেকে ওঠার আগেই চলে যেতে দেখা যায়, তার সঙ্গে রাত কাটানো অপরিচিত ব্যক্তিকে। অপরিচিত আন্নাকেও সন্দেহ করেন না স্যাক্সোফোন বাদক লিস। লিসের ঘুম ভাঙার আগেই সেখান থেকে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। বুঝতে বাকি থাকে না উয়ান্ডারা কতোটা আন্তরিক, আর কতোটা উদার মনের। নিঃসন্দেহে এদের উদারতাকে স্যালুট করা যায়। অন্তত পাউলিকোস্কি তো দুহাত উঁচিয়েই স্যালুট করেন।
আন্নাদের মতো মানবতা অবশ্য অস্কারের দেশ যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতই দেখায়। রাসায়নিক সারিন গ্যাস হামলায় সিরিয়াতে শিশুসহ ৭০ জন নিহতের পর মানবতার বিপর্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে মার্কিন প্রশাসন।৫ যেমনটা নিজের শিশু হত্যা নিয়ে উয়ান্ডা মানবিক হয়ে ওঠেন, সেরকম। যদিও সিরিয়াতে মানবতার বিপর্যয় ঠেকাতে সেই যুক্তরাষ্ট্রকেই টমাহুক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে দেখা যায়। এই হামলা নিয়েও তারা অবশ্য বার বার মানবতার বুলি-ই আওড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই এ রকম মানবিকতা, মানবাধিকারের কথা শুনতে, বলতে পছন্দ করে। পাউলিকোস্কি’’কে তো তাদের পছন্দের সেই পথ ধরেই হাঁটতে দেখা যায়।
স্বপ্নহীনতার পিছনেও কি উদ্দেশ্য আছে?
উয়ান্ডার বাড়িতে আসার পরও গির্জার আশ্রমে পরে থাকা নিজের পোশাক পরিবর্তন করেন না আন্না। কিন্তু বেশ কয়েকবার উয়ান্ডা তাকে পোশাক পাল্টে ফেলার কথা বলতে থাকেন। আন্না তাতে রাজি হন না। এমনকি বারে পর্যন্ত তিনি ওই পোশাকেই যান। এর পর আরেকদিন নাইট ক্লাবে যাওয়ার আগে উয়ান্ডা তাকে পোশাক বদলানোর কথা বললে, কেবল পোশাক না বদলানোর কারণে বাসায় থাকতে চান আন্না। অগত্যা উয়ান্ডা তাকে হাসির ছলে জানান, পোশাক না বদলালেও কোনো সমস্যা নেই।
কয়েক দিনের মধ্যে তাদের সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে। আন্নার প্রশংসা করার ফাঁকে তাকে সংসারি হওয়ার কথা বলেন উয়ান্ডা। জানতে চান আন্না কখনো স্বামী, সংসারের কথা ভাবেন কি না। এমনকি ক্লাবের সেই বাদক লিসের সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু আন্নাকে যে জীবনের প্রতি উয়ান্ডা আহ্বান জানান; তিনি নিজেই সে জীবনের মায়া ত্যাগ করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন! নিজেই যিনি জীবনকে ভালবাসতে না পেরে আত্মহত্যা করেন, সেই জীবনের দিকে অন্য কাউকে কীভাবে ডাকতে পারেন উয়ান্ডা! তাহলে কোন জীবনের প্রতি আন্নাকে আহ্বান করেন তিনি? যে জীবনের পরিণতি মৃত্যু দিয়ে শেষ হয়!
অবশ্য পর্দায় আবির্ভূত হওয়ার শুরুর দৃশ্য থেকেই উয়ান্ডাকে বিমর্ষ, চিন্তিত দেখায়। নিজের অর্থহীন যন্ত্রণাময় জীবন থেকে হয়তো তিনি মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন¾আত্মহত্যার সেটা একটা বড়ো কারণ হতে পারে। তাছাড়া ছেলের মৃত্যুর খবর শোনা এবং তার দেহাবশেষ তুলে অন্য জায়গায় পুঁতে রাখার পর হয়তো ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু পুত্র-শোকে তো উয়ান্ডার আত্মহত্যা করার কথা নয়। যদি সেটাই হতো, তাহলে আরো ২২ বছর আগে সেই শোকে তিনি আত্মহত্যা করতে পারতেন। তাহলে এ সময় এসে কেনো তার আত্মহত্যার প্রয়োজন পড়ে; এর পিছনে কারো দায় আছে কি না, তা তুলে ধরেননি পাউলিকোস্কি।
তবে এটুকু জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে ইহুদি নিধনযজ্ঞের পর সোভিয়েত রেড আর্মি পোল্যান্ড দখলে নিলে স্তালিনের সমর্থক হয়ে ওঠেন উয়ান্ডা। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তার বিশ্বাস হোঁচট খায়। ধীরে ধীরে নিজেকে একটি ফ্ল্যাটে বন্দি রেখে সিগারেট, মদ্যপান আর বাছবিচারহীনভাবে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন উয়ান্ডা। সবমিলিয়ে তিনি এক ‘উচ্ছৃঙ্খল’ জীবন যাপন করতে থাকেন। আন্না যখন তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তখন তিনি সম্পূর্ণভাবে এক বিধ্বস্ত মানুষ।
নিজের সব হারিয়ে স্তালিনের মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়েছিলেন তিনি। পরে আবার স্তালিনবিরোধী হয়েছেন। স্তালিনকে তার আগে ভালো লাগলেও পরে লাগেনি। তার বিষণ্নতার কারণ যদি সেটা হয়, আত্মহত্যার ঘটনা তো সেই ঘটনারই শেষ রূপ। এদিক থেকে বিবেচনা করলে তো উয়ান্ডার মৃত্যুর জন্য স্তালিনকেও দায়ী করা যায়। তাছাড়া উয়ান্ডা মারা যাওয়ার পর সেই বাড়িতে আবার ফিরে আসেন আন্না। এবারে আন্নাকে দেখা যায়, বদলে যাওয়া এক নতুন চরিত্রে। আন্না গির্জার পোশাক খুলে ফেলে উয়ান্ডার বাসায় তারই গাউন পরেন, সিগারেট, মদ্যপান করতে থাকেন। এমনকি লিসের সঙ্গে যৌন সম্পর্কও স্থাপন করেন।
তাহলে আন্নার পরিণতিও কি উয়ান্ডার মতো হবে? শেষ পর্যন্ত আন্নাকে অবশ্য পথ পরিবর্তন করে নিতে দেখা যায়। ভুলক্রমে প্রথমে উয়ান্ডার পথে পা বাড়ালেও পরে তার ভুল ভাঙে; ফিরে যান আশ্রমে। আন্নাকে আশ্রমে ফিরিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে পাউলিকোস্কি কী বোঝাতে চান—উয়ান্ডার মতো ভুল পথে নয়, ধর্মের পথে ফিরে আসো; জীবনটা আশ্রমে কাটিয়ে দাও। অন্যভাবে দেখলে স্বয়ং উয়ান্ডার মুখ দিয়ে স্তালিনবিরোধী কথা বলিয়েছেন নির্মাতা। কিন্তু কোনো পরিস্থিতি বর্ণনা করতে হলে তো সেই সময়ের সবকিছু বিবেচনায় রাখতে হয়। ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক বিক্ষিপ্ত কিছু বিষয় দিয়ে তো আর সামগ্রিক বিষয় উঠে আসে না। এতে কেবল খণ্ডিত ও আংশিক বিষয় ধরা দেয়। যদিও পাউলিকোস্কি সেটাই করেন। অস্কার কর্তৃপক্ষেরও তো শত্রুপক্ষ-বিরোধী বক্তব্য বেশ পছন্দনীয়। পাউলিকোস্কি’র এই উপস্থাপন কি তাহলে অস্কার জয়ের আরেক টোপ?
যুক্তির আড়ালে গোষ্ঠী উদ্ধার
পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী, যাকে মানুষ হয়ে উঠার জন্য চেষ্টা করতে হয়। মানুষের কৌতূহলী মন চারপাশের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে ভাবতে থাকে। কিন্তু তারা ঠিক কতোখানি পর্যন্ত ভাবতে পারবে, তার সীমা নির্ধারণ করে দেয় বিভিন্ন ধর্মীয়, আইনি প্রতিষ্ঠান। আবার এক ধর্ম-মতাদর্শ খারিজ করে দেয় আরেক মতাদর্শকে। নিজেদেরকে সবচেয়ে আধুনিক ধর্ম হিসেবে দাবি করা ইসলামও আবির্ভাবের পর পরই ঘোষণা দিয়েছে, তারাই সেরা। এই সেরা হওয়ার কারণে তাদের অনুসারীদের চিন্তাভাবনা, জানাশোনার পরিধিও নির্ধারিত হয়ে যায়।
উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি আলোচিত কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। কওমি মাদ্রাসাগুলোতে কোরআন, হাদিসের বাইরে অন্যান্য ধর্ম-মতাদর্শ সম্পর্কে জানার সুযোগ নেই বললেই চলে। এমনকি বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোতে কোরআন, হাদিসের অনুবাদ পড়ানো হয় উর্দুতে। যে মানুষ জীবনে কখনো জানলোই না, একই বিষয়ে অন্যান্য ধর্মের (একই ধর্মের মধ্যেও আবার বিভিন্ন শাখা ও মত রয়েছে) মতামত কী; সে দুটো ভিন্নমতের পার্থক্য বুঝবে কীভাবে? আর কেউ যখন কেবল একটা বিষয় সম্পর্কেই জানবে, তার কাছে সেটা মূল্যায়নের কোনো উপায়ও থাকে না। কারণ কোনো কিছুর সাপেক্ষ ছাড়া সম্ভব হয় না, সেটির মূল্যায়ন করা। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়, একটি রেখা ছোটো নাকি বড়ো সেটা পরিমাপের জন্যও সাপেক্ষ হিসেবে আরেকটি রেখার প্রয়োজন পড়ে। এই সাপেক্ষ ছাড়া যেমন ছোটো-বড়ো নির্ধারণ করা যায় না, একইভাবে চাপিয়ে দেওয়া কোনো মতাদর্শ সেভাবে ধারণ করাও সম্ভব না।
কিন্তু ইডায় দেখা যায়, গির্জার আশ্রমে আন্নাসহ অন্যরা কড়া অনুশাসনের মধ্যে বেড়ে ওঠে। অক্ষরে অক্ষরে পালন করে নানদের ইশারা। সেখানে বাইরের জগৎ সম্পর্কে তাদের তেমন ধারণা থাকারও কথা নয়। কেবল বাইবেল পাঠ, যিশুর বন্দনা করে রুটিনমাফিক চলাফেরা তাদের। কিন্তু প্রথমবারের মতো বাইরের পৃথিবীতে এসে ভিন্নতা চোখে পড়ে আন্নার। এখানকার খাবারদাবার, মানুষজনের চলাফেরা এমনকি যৌনতার বিষয়ে প্রথমবারের মতো কেউ তাকে আগ্রহী করে তোলে। অথচ গির্জার সিস্টাররা কোনোদিনই উপলব্ধি করতে পারে না, কোনো পুরুষের সঙ্গে মিলনের কী তৃপ্তি। আন্না এতোদিন অন্যসব সিস্টারের মতো যৌন মিলন থেকে বিরত থেকেছেন। কিন্তু যৌন সুখ কেমন, আর কেনোইবা তিনি তা থেকে বিরত থাকবেন কিংবা বিরত থাকাটাও যে যৌক্তিক, সেটা তার অজানা ছিলো। ফলে বাইরের পৃথিবীতে এসে লিসের সঙ্গে প্রথমবারের মতো যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন আন্না।
সেই সঙ্গে প্রথমবারের মতো তিনি বিচার করার ক্ষমতা পান—গির্জার সিস্টার আর যৌন সম্পর্কে লিপ্ত কোনো মানুষের মধ্যের তফাৎটা। ধরে নিলাম, গির্জার নান হয়ে কেউ সারাজীবনে কোনোদিন যৌন সম্পর্কে জড়ালো না। তাহলে তো তিনি যৌনতা সম্পর্কে কিছুই উপলব্ধি করতে পারবেন না। এবার এটাও ধরে নিলাম, লিসের সঙ্গে ভুল করে আন্না যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। কিন্তু সেই কাজটা ঠিক নাকি ভুল হয়েছে, সেটা বিবেচনার ক্ষমতা মানুষের আছে। আন্নার ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটতে দেখা যায়। লিসের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পর, আন্না তাকে প্রশ্ন করেন এরপর কী হবে তাদের? লিস জানান, তারা একটা কুকুর কিনবেন; এরপর বিয়ে করবেন; বাচ্চা হবে, সংসার হবে; যেভাবে আর মানুষজন জীবন কাটিয়ে দেয়, তারাও দেবেন।
নিশ্চুপ আন্না হয়তো দুই জীবনের হিসেব মেলাতে থাকেন। সেই হিসাবের ফলাফলে গির্জাকেই বেছে নেন তিনি। লিসকে ছেড়ে রওয়ানা দেন গির্জার পথে। কিন্তু কোনো বিষয়ে চলতি রীতি ভাঙলে তো আগের বৈশিষ্ট্য থাকে না; পাল্টে যায় অনেক কিছুই। আন্না যৌন সম্পর্কের স্বাদ নিয়েছেন; এরপর তিনি হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছেন গির্জাই তার উপযুক্ত স্থান। সেকারণে জোর পায়ে দৃঢ় সংকল্পে গির্জার পথে পা বাড়ান তিনি। এবারে কিন্তু আর ধর্মভীরু হয়ে গির্জায় যান না আন্না—একেবারে ধর্মপ্রাণ হয়ে। গির্জার নানের দায়িত্ব নেন না ঠিকই, যিশুকে ধারণ করেন অন্তর থেকে।
সবই ঠিক আছে, কিন্তু নির্মাতা পাউলিকোস্কি যে গির্জার সিস্টারকে (যিনি নান হওয়ার জন্য মনোনীত) এনে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে দেখালেন; সিগারেট, মদ্যপান করালেন, তার উত্তর কী হবে? চলচ্চিত্রজুড়েই খ্রিস্টানদের নেতিবাচক উপস্থাপনের পর গির্জার সিস্টারদের একেবারে গুষ্টি (গোষ্ঠী) উদ্ধার করে দিলেন তিনি। তা কি কেবল চলতি রীতি ভাঙা দেখানোর নিমিত্তে নাকি অন্য কোনো মতলবে?
পুরস্কারের ‘যোগ্য’’ দাবিদার
গির্জার আশ্রমে থাকা আন্না তার খালা উয়ান্ডার কাছে জানতে পারেন, তিনি আসলে ইডা লেবেনেস্টেইন। ইহুদি জানার পরও খ্রিস্টান ধর্মানুসারে আশ্রমের সেই অভ্যাস বদলান না তিনি। আন্না হয়ে গির্জার সেই পোশাক পরে ঘুরে বেড়িয়েছেন বার থেকে সমাধিস্থলে। এমনকি চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যেও আন্না হয়েই ফিরে যান তিনি। এর মধ্যে খুবই স্বল্প সময়ের জন্য তাকে ইডা হতে দেখা যায়। অথচ চলচ্চিত্রের নামকরণে ইডারই প্রাধান্য দেন পাউলিকোস্কি। চলচ্চিত্রজুড়ে আন্নার বিচরণ হার মেনে যায় ক্ষণিকের ইডার কাছে। নামের ক্ষেত্রে নির্মাতার ইহুদি ইডাকে বেছে নেওয়াও পক্ষপাতদুষ্ট কি না সেটাও বিবেচ্য বিষয়।
তবে অস্কারের দেশ যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই সমর্থন পছন্দ করে, বিরুদ্ধমত নয়। সেকারণেই চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিঙ’’কে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে তুলোধুনা করা হলেও ২০১৭-তে এসে তারই প্রশংসা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কারণ এ সময় উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বন্ধের আশ্বাস দেয় চিন। অন্যদিকে মার্কিন প্রশাসনের কাছে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জঙ উন হয়ে ওঠেন ক্ষ্যাপাটে লোক। তাদের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা হয়ে যায় অত্যন্ত খারাপ কাজ। চলচ্চিত্রজুড়ে পাউলিকোস্কি যা কিছু দেখিয়েছেন তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কেবল সমর্থনই চোখে পড়ে!
আর যুক্তরাষ্ট্রের তো পোল্যান্ডের কাছ থেকে সমর্থনই দরকার। রাশিয়ার আগ্রাসী হয়ে উঠা নিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ন্যাটো জোটের উদ্বেগ প্রশমনে সামরিক সহায়তা দিতে চেয়েছিলেন। সে অনুযায়ী ট্যাংক, ভারী যুদ্ধাস্ত্র ও মার্কিন সেনা পাঠানো হয় পোল্যান্ডে।৬ রাশিয়ার বিরোধিতা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র যুক্তি দেখায়, এই সেনারা পোল্যান্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। চলচ্চিত্রেও রাশিয়ার বিরোধিতা করতে দেখা গেলেও, যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে কোনো কথা নেই! তাছাড়া ইডাকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে পোল্যান্ডে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের স্বীকৃতির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র সে দেশে নিজেদের কার্যক্রমই সমর্থন করে। সেই দিক বিবেচনায়, নিজেদের কার্যক্রম সমর্থন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতাকারীদের মুখে কুলুপ এঁটে দেওয়ার জন্যে অস্কারের চেয়ে মোক্ষম উপায় আর কীইবা হতে পারে!
লেখক : কাওসার বকুল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বর্তমানে তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কম এ সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।
bokulmcj71@gmail.com
তথ্যসূত্র
১. কবিতার লাইন কয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘‘পুরস্কার’’ কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে।
২. নেমেস, লাজলো; ‘চলচ্চিত্র পরিচালনা বুঝতে হলে, অবশ্যই ফিল্ম ক্যামেরায় কাজ করতে হবে’’; ভাব-ভাষান্তর : রাশেদ রিন্টু; ম্যাজিক লণ্ঠন; সম্পাদনা : কাজী মামুন হায়দার; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, বর্ষ ৫, সংখ্যা ১০, জানুয়ারি ২০১৬, পৃ. ২৭৬।
৩. লি, স্পাইক; ‘‘আমরা এক বিশৃঙ্খলার মধ্যে আছি’; ভাব-ভাষান্তর : কাওসার বকুল; ম্যাজিক লণ্ঠন; সম্পাদনা : কাজী মামুন হায়দার; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, বর্ষ ৬, সংখ্যা ১১, জুলাই ২০১৬, পৃ. ২৮৩।
৪. http://www.imdb.com/name/nm0667734/bio?ref_=nm_dyk_qt_sm#quotes; retrieved on 10.05.2017
৫. https://goo.gl/xpQwbr; retrieved on 19.05.2017
৬. https://goo.gl/8Po7on; retrieved on 19.05.2017
মতামত
এই লেখায় মতামত দিতে লগ-ইন অথবা নিবন্ধন করুন ।