ম্যাজিক পুনর্পাঠ » সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা ও সঙ্গীত
সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা ও সঙ্গীত
সত্যজিৎ রায় আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। রয়ে গেছে তাঁর সৃষ্টির সম্ভার। তাঁর অনন্য সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা আজও চলছে। এখানে এই রচনার মধ্যে সত্যজিতের ছবি ও সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সত্যজিৎ রায়ের ছবির প্রাসঙ্গিকতা ও তাঁর সঙ্গীত চেতনা বিষয়টি যেমন অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি খুবই কঠিন দায়িত্ব, অন্তত আমার ব্যক্তিগত বিচারে। তাছাড়া, তাঁর ছবি ও সঙ্গীতের প্রাসঙ্গিকতা যথার্থ অর্থে বিশ্লেষণ করতে গেলে সেটি একটি গ্রন্থের আকার ধারণ করতে বাধ্য। কাজেই এই স্বল্প পরিসরে তাঁর সমস্ত ছবির বিস্তারিত বিশ্লেষণ, বিশেষত সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা বা সঙ্গীত চেতনা প্রসঙ্গে লিখতে গেলে বিষয়টির সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ ছাড়া উপায় নেই। এবং সমস্ত ছবিরই বিশ্লেষণও সম্ভব নয়। তথাপি, চেষ্টা করছি যাতে উক্ত বিষয়টি সম্পর্কে পাঠকদের আমি কিছুটা অবহিত করতে পারি। যদিও এ আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অভিমত এবং সেক্ষেত্রে সকলের মতের সঙ্গে মিল নাও হতে পারে।
প্রথমেই যেটা মনে হয়েছে যে, সত্যজিৎ রায়ের ছবির সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা ও সঙ্গীত চেতনা, অর্থাৎ, “পথের পাঁচালি” থেকে “আগন্তুক”—সেটার সামগ্রিক বিচারের ভার যথার্থ চলচ্চিত্র সমালোচক ও সমঝদারের উপর বর্তায়। কিন্তু, সত্যজিৎ রায় যে মানের ছবি করে গেছেন, অর্থাৎ তাঁর ছবির স্ট্যান্ডার্ড—সেই মানের বা স্ট্যান্ডার্ডের চিত্র সমালোচক ক’জন আছেন আমাদের দেশে? আমি একটি সাক্ষাৎকার নেবার সময় কথাপ্রসঙ্গে মানিকদা (সত্যজিৎ রায়/ ২.৮.৮২ আনন্দলোকে প্রকাশিত) বলেছিলেন—এখানে যারা সমালোচক আছে, তারা হয়তো এ দেশের কালচারাল দিকটা সম্বন্ধে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত, বিদেশি সমালোচাকদের থেকে বেশি। কিন্তু সেখানে আবার তাঁদের অন্য দিকে খামতি আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখি যে, ‘সিনেমা ব্যাপারটা তাঁরা মাথায় রাখে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখি, তাঁরা বিষয়বস্তু নিয়ে বিচার করেন এবং বিষয়বস্তুও যাচাই করেন তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে, ফলে, সেটা অনেক সময়েই হয় তাঁদের একপেশে মতামত। প্রায় অনেক সমালোচনা পড়েই আমার মনে হয়েছে, একজন সমালোচকও সিনেমা বিষয়টাকে ঠিক হৃদয়ঙ্গম না করে, ভাল মতন না বুঝেশুনে সে সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানী জ্ঞানী মতামত লিখছেন। যেমন তথাকথিত যাঁরা নামকরা চিত্রসমালোচক, যেমন চিদানন্দ দাশগুপ্ত। তাঁর বই পড়ে অনেক সময়েই আমার মনে হয়েছে, এই যে ছবিটা সম্পর্কে লিখলো, কিন্তু এই ছবিটার আশ্চর্য দিক, চলচ্চিত্রশিল্পের দিক থেকে যেখানে দৃশ্যটা ভীষণ সার্থক, ইমাজিনেটিভ অরিজিন্যাল কই, সে সম্পর্কে তো কিছু লিখল না! যেমন এই প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ মনে পড়ে যায়—“প্রতিদ্বন্দ্বী” সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা হয়েছে, এমন কি তার বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক প্রশ্নও তোলা হয়েছে; কিন্তু “প্রতিদ্বন্দ্বী”র শেষ দৃশ্যে, যেখানে দশ/বারো মিনিট ধরে কিছু হয় না, এবং সেই দশ/বারো মিনিটের মধ্যে হঠাৎ আমরা ৩০/৪০টা চরিত্রকে দেখতে পাই, যারা ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। এবং সেখানে কেন্দ্রস্থ চরিত্রকে দেখি, সেও এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে, কখন ডাক পড়বে তার আশায়। তারপর আস্তেআস্তে তার মধ্যে একটা ভীষণ রাগ, ক্ষোভ জমে ওঠে। এই যে দশ/বারো মিনিট, আমার মনে হয়েছে এটা একটা অসম্ভব, একটা কঠিন জিনিসকে উতরে দেওয়া হয়েছে। মানে, কীভাবে হয়েছিল, সেটা কেউ যদি অ্যানালাইজড করতে না পারেন, তাহলে আমি তাঁকে কী করে বলব, তিনি একজন সিনেমা সমালোচক, সিনেমা বোঝেন! কী করে সম্ভব হল ওই দৃশ্য?
প্রথমত : যা দেখে তাকেই মেনে নেয়। হ্যাঁ ঠিক আছে। তার পিছনে যে কী চিন্তা আছে, চিন্তাটা কোথায় আছে, কেন আছে, ওটা অর্ধেক সমালোচক অধিকাংশ সময়ে বোঝে না, ফলে অ্যানালিসিস হয়না। সে জন্য অনেকেই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’কে তো উড়িয়েই দেয়। যাই হোক, সে জন্য তাদের ব্যক্তিগত রুচি-অরুচির ব্যাপার। কিন্তু তা বলে, ওই যে সাতজন মিলে একটা খেলা আছে, মেমারি গেম, যেটা, সেই দৃশ্য যে কত কমপ্লেক্স এবং সেখানে যে কত স্তরের কথা, একসঙ্গে বলা হয়েছে, অল্প সময়ের মধ্যে দিয়ে, আপাতদৃষ্টিতে একটা খেলার মধ্য দিয়ে, সেটা যে না অ্যানালিসিস করে দেখতে পারবেন বা অন্তত, এই দিকটায় আঙুল দেখাতে পারবেন, যে হ্যাঁ, এ দৃশ্যটার বিশেষত্ব হল এই ...। সেটা যে বলতে না পারবে, তাকে আমি ক্রিটিক বলব না। যেমন আমার অনেক ছবির যে সব দৃশ্য নিয়ে আমি ভেবেছি আলাদা করে, মানে আমার inspiration-এ, মানে যেখানে একটা সত্যিকারের ভাবনাচিন্তার ব্যাপার আছে, এবং একটা কঠিন জিনিসকে আপাতদৃষ্টিতে সহজ করে ফেলার চেহারা আছে, সেটা যদি কেউ ধরতে না পারে, তাহলে তো আমি তাঁকে ক্রিটিক বলব না। অর্থাৎ ওইগুলো আমি স্পেশাল সিনেমাটিক কোয়ালিটিস বলি, সেটা পুরো ছবি বাদ দিয়ে নয়, যেখানে ছবিটা ভালো লাগছে না, কিন্তু তার মধ্যে যে একটা Exceptional দৃশ্য আছে, সেটা না বললে তো আমি সেটাকে সঠিক সমালোচনা বলব না। পুরো “কাঞ্চনজঙ্ঘা”র যে স্ট্রাকচারটা কতখানি নতুন, কই সেটা তো কেউ বলল না? সেখানে কোনও কেন্দ্রস্থ চরিত্র নেই, গোটা ফ্যামিলিটাই একটা চরিত্র। ঘুরে ঘুরে আমরা ওই ফ্যামলির এক একজনকে দেখছি, মিউজিকের মতন আসছে—এই জিনিসটা, যদি কেউ ধরতে না পারেন, অর্থাৎ মূল স্ট্রাকচারের যে originality, সেটা যদি কেউ ধরতে না পারে, অ্যানালিসিস করতে না পারে, তাহলে আমি তাকে ক্রিটিক বলব না। তাছাড়া, কিসব অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য লেখে ছবিটা ভাল, এডিটিং খারাপ। একটা ছবির এডিটিং খারাপ হলে সেটা ভাল ছবি হতে পারে? এসব কথা মাথায় রেখেই চলে আসা যাক সত্যজিতের ছবির সামাজিক প্রাসঙ্গিকতায় যা শিল্পের প্রশ্নেও অর্থাৎ এস্থেটিক একসেলেন্স-এর প্রশ্নেও চিরন্তন। কিন্তু, তাঁর এই চিরন্তন ছবির প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার আবহসঙ্গীত, গান অর্থাৎ সঙ্গীতচেতনা—যা ভারতীয় তথা বিশ্বের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও বড়ই দুর্লভ, বড়ই বিরল। সম্ভবত চ্যাপলিন ছাড়া খুব কমই পরিচালক আছেন, এই সঙ্গীতচেতনার প্রশ্নে। এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যে কোনও ক্ল্যাসিক ছবির প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে কিন্তু জড়িয়ে থাকে তার আবহসঙ্গীত এবং গান। তা না হলে ছবির মূল থিম, শ্রেণী, চরিত্র, প্রাত্যহিক জীবনের জীবন্ত চেহারাটাকে বোঝা যাবে কী করে? তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর পটভূমিতে যে গল্প তার আবহসঙ্গীত আর বিংশ শতাব্দীর সাতের দশকের পটভূমিতে রচিত ছবির আবহসঙ্গীত কি এক হতে পারে? কাজেই বিষয়বস্তুর প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে সঙ্গীতের প্রাসঙ্গিকতাও জড়িত, শৈল্পিক উৎকর্ষের প্রশ্নে। প্রথমেই চলে আসা যাক সত্যজিৎ রায়ের ছবির সামগ্রিক প্রাসঙ্গিকতা ও শিল্পের প্রশ্নের আলোচনায়।
“পথের পাঁচালি”, ““অপরাজিত”, ““অপুর সংসার”, অর্থাৎ অপু ট্রিলজি—যা আজও প্রাসঙ্গিক। একজন দরিদ্রব্রাহ্মণ, শিক্ষিত মানুষ—হরিহর। গ্রামবাংলায় ও শহরে জীবনসংগ্রামের প্রশ্নে আজও প্রাসঙ্গিক হরিহরের চরিত্র। কতগুলো উদাহরণ দিচ্ছি—১। হরিহর খালি স্বপ্ন দেখে সে দারুণ পালা লিখছে, বাকি পেশাদারী পালা লিখিয়েরা তার সঙ্গে পারবে না। সেই স্বপ্নে সে স্ত্রীকে বোঝায়, ভাঙা চালাটা সারাবে, সংসারের অভাব মেটাবে ... ইত্যাদি! এই স্বপ্ন শুধু হরিহরের কেনো, বাংলার বহু কবি, সাহিত্যিকই দেখেছেন, দেখেছিলেন, এখনও দেখছেন। সে স্বপ্ন কতটা সফল হতে পারে, কিভাবে হতে পারে, আদৌ হতে পারে কি না—এসব প্রশ্ন জড়িয়ে আছে এই সমাজের রাজনৈতিক প্রশাসনের লবি, গোষ্ঠী ও আমলাতন্ত্রের মুঠোয়। তাই আজও এ দেশের ট্রাডিশন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখকের মৃত্যু, সুকান্ত’র অকাল প্রয়াণ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর অসহনীয় অভাব, ঋত্বিক ঘটকের অধিক হতাশাজনিত অ্যালকোহলিক পরিণতি। কাজেই হরিহরের সংসারের বা “অপরাজিত””তে, অপুর পুরোহিতের কাজ সেরে স্কুলেভর্তি হয়ে কৃতী ছাত্র হওয়ার স্বপ্ন বা “অপুর সংসারে” অপর্ণাকে বিবাহ করার জন্য যে মানবিক মূল্যবোধ এবং কাজলকে অপর্ণার মৃত্যুর জন্য দায়ী ভেবে বিষণ্নতায় একা একা, নিঃসঙ্গভাবে ঘোরা, তারপর সরাসরি কাজলের সঙ্গে সাক্ষাতের দৃশ্যে বাবা-পুত্রের যে বন্ধুত্বের মিলন—এমন দৃশ্য বা ঘটনার উপস্থাপনা সমাজের বাইরে আছে নাকি?
“জলসাঘরে”” ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত প্রভুর মেজাজ আভিজাত্যের ও রক্তের গর্বের সঙ্গে অর্থাৎ ব্লু-ব্লাড বনাম মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার যে দ্বন্দ্ব শেষ দৃশ্যে যেটা প্রাণবন্ত এবং ভয়ংকরভাবে তথ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে বিশ্বম্ভরের নাচঘরে শেষ সম্বল রূপোর রেকাবি বিক্রি করে রোশনকুমারীর নাচের আসর বসানো এবং নর্তকীকে নজরানা দেবার সময় ছড়ি দিয়ে গঙ্গাপদ বসুকে আটকে দেওয়া এবং সেই সব সংলাপ—অনন্ত! সব নিভে যাচ্ছে—অর্থাৎ বেনিভোলেন্ট ফিউডাল লর্ড, যাঁরা ধনী ছিলেন, শোষণকারীও ছিলেন, কিন্তু ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট নব্য মুৎসুদ্দি সামন্ত দালালদের সঙ্গে জীবনে আপোস করতে পারেননি, উল্টো সেই কারণে মৃত্যু বরণও করেছেন। এটা কি আমাদের অতীত সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের থেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা? কিংবা “দেবী””? তান্ত্রিক কালীভক্ত শ্বশুর, হঠাৎ স্বপ্নে ছোট পুত্রবধূকে কালী-প্রতিমার সঙ্গে মিলিয়ে ফেললেন। তারপর সেই পুত্রবধূকে বসালেন জাগ্রত কালীর আসনে। মাটির মূর্তি নয়, জীবন্ত নারী! সংশয় আর যন্ত্রণা নিয়ে কতটা কষ্ট পেল দয়াময়ী! রক্তমাংসের মানবশরীরে দেবীত্ব আরোপ কি সহজ কথা? তারপর কলকাতা থেকে ছোট ছেলে যখন সব শুনে আধুনিক শিক্ষার আলোয় বুঝতে পারে বাবার কুসংস্কার, স্ত্রী’র অস্বাভাবিক জীবন। সে চাইল স্ত্রীকে নিয়ে পালাতে। কিন্তু সংস্কার, কুসংস্কার বিশেষত ধর্মীয় প্রেজুডিস যাবে কোথায়? উল্লেখ্য—দয়াময়ী এমনই সম্মোহিত বা হিপনোটাইজ্ড্ হয়েছে কয়েকটি কাকতালীয় ঘটনায়, যাতে সে ভাবতে শুরু করে দেয়, হয়তো সত্যিই সে দেবী! যদি সত্যি সে দেবী হয়ে থাকে, তাহলে? দয়াময়ী স্বামীর সঙ্গে পালিয়ে যেতে পারল না। কিন্তু পরিণতিতে দেখলাম যে ভাশুরের শিশুপুত্র, “কাকিমা”” বলতে যে অজ্ঞান, তার অসুখ চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছনোর সময় জাগ্রত দেবী ছোট পুত্রবধূর কোলে তাকে তুলে দেওয়া হল। যদি সে বাঁচে, শেষ চেষ্টা!
এইখানেই সত্যজিৎ, সত্যজিৎ! ধর্মীয় কুসংস্কার কখনও মানুষকে বাঁচায় না, বরং তা এক কানাগলি ছাড়া কিছুই নয়। শিশুটি মারা যায়। দয়াময়ীরও মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটে। সেও ছুটে যায় মৃত্যুর পথে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, সেই আমলে নব্যশিক্ষায় শিক্ষিত পুত্র বাবাকে সরাসরি দায়ী করছে—তার স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য। প্রতিবাদ করছে তার বাবার ভণ্ডামী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। এই প্রতিবাদ কি আজও প্রাসঙ্গিক নয়?
পরশ পাথর—ফ্যান্টাসি কিন্তু সেখানেও এক প্রৌঢ় কেরানির জীবনের যে জীবন্ত চরিত্র, পরিবার ও শেষ করুণ ও হাস্যময় পরিণতি দেখা গিয়েছে। সেটা একমাত্র সত্যজিৎ রায়ের পক্ষেই সম্ভবপর হয়েছে। কারণ, আমাদের বাস্তব জীবনে সাধারণ মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী মানুষের পদোন্নতি হলেই তাদের মনে ও পরিবারে যে আনন্দ আসে, সেখানে পরেশবাবুর মতো একজন মাছিমারা কেরানি, তিনি পরশপাথর কেন, একটা লটারির টিকিটে যদি এক লক্ষ টাকাও পেতেন, তাহলেও তার জীবনে হাসতে হাসতে আনন্দাশ্রু বেরিয়ে আসত!
আর সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হাজার একটা স্বপ্ন উদয় হত, এমন কি, আমাদের সমাজের অধিকাংশ লোক লটারির টিকিট কাটে কেন? তা নিয়ে কি তারা কম স্বপ্ন দেখেন? আর, নম্বরটা না উঠলে মুখখানা অমন পাংশু হয়ে যায় কেনো? রূঢ় বাস্তব জীবনের এই জীবনসত্যকেই সত্যজিৎ রায় ফ্যান্টাসির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সুস্বাদুভাবে। কাজেই, বলাই বাহুল্য এ ছবির সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনা।
“অরণ্যের দিন রাত্রি”” বা ““প্রতিদ্বন্দ্বী”র বিষয়বস্তু বা message নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তর্ক চলতে পারে, কিন্তু তার কারিগরী উৎকর্ষ এবং বিশেষ কিছু দৃশ্য যা ভোলার না। অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়ের ভাষাতেই বলি যে : একটা ছবি হয়তো সামগ্রিকভাবে আমাকে টানলো না, কিন্তু হয়তো বিশেষ কিছু দৃশ্য যা outstanding যদি আমি সেটার প্রশংসা না করি, সে ছবির ওই আশ্চর্য দৃশ্যগুলো তো অস্বীকার করা যায় না। এখন প্রশ্ন হ’ল—যদি বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ ছবির বিচার করতে বসা হয়, তবে প্রশ্ন জাগে, যিনি এই বিচারে বসবেন ও রায় দেবেন, তিনি কোন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন? কারণ, একটা জিনিস খুব পরিষ্কার ভাবে লক্ষ করা গেছে যে সত্যজিৎ ধীরে ধীরে সমাজের অবক্ষয়, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, স্বার্থ এবং এই প্রশাসনকেও লক্ষ্য করে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেছেন ক্রমাগত। যা আজকের দিনের মানবিকতা ও মূল্যবোধের প্রশ্নে একান্তভাবে জরুরি ও প্রত্যাশিত। যেমন “জন অরণ্যে””এ ১. পরীক্ষার খাতা দেখার দৃশ্য। ২. বেকার যুবকের চাকরি পাওয়া এবং ৩. কীভাবে চাকরি পাওয়া। ৪. বড় ছেলের মুখে ‘‘ঘুষ’’ শব্দটা শুনে বাবা থমকে যান আবার ওই বাবারই মুখে যখন শোনা যায় ““আমরাও তো স্বদেশীদের দেখছি, কিন্তু এদের মতো আত্মত্যাগ তো দেখিনি!”” অর্থাৎ ৭০ দশকের সেই সব যুবকদের কথা, যাদের রক্তে বাংলা তথা ভারতবর্ষের বহু রাস্তাঘাট, অলিগলি মাঠ ভিজে গেছিল। সরকার সেগুলোকে ঘষে মেজে নতুন পিচ ঢেলে জেব্রা দাগ কেটে মুছে ফেলেছে—কিন্তু স্পট গুলো তো মুছে যায়নি! এ সাহস কিন্তু তাঁর সমসাময়িক আর কোনও পরিচালকের হয়নি। “মহানগর” ছবিতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীর প্রতিনিধি আরতি। এই জীবনকে সত্যজিৎ যে কি ভাবে স্টাডি করছেন—তা ছবিটি না দেখলে বোঝা যাবে না। আরতির চাকরি করা নিয়ে স্বামীর সন্দেহ, সংসারে অসন্তোষ সত্ত্বেও আরতি বোঝে টিকে থাকার প্রশ্নে তার চাকরিটা কী ভীষণ জরুরি। সে তার সমস্ত দায়িত্ব পালন করার পরও সংসারের শান্তির প্রশ্নে রেজিগনেশন লেটার দিতে যায়।
তখনি তার স্বামী তাকে উদভ্রান্তের মতো ফোন করে জানায়, চাকরিটা যেন সে না ছাড়ে, কেননা তার স্বামীর অফিস অর্থাৎ ব্যাঙ্ক ফেল করেছে। সেই মুহূর্ত থেকে আরতির নাতিক্ষুদ্র সংসারে আরতির উপার্জনটুকুই সম্বল। কিন্তু সেই আরতি, অতি সাধারণ মেয়ে আরতি, যে সেল্গান জানে না, কোনও দলে ভেড়েনি, সে প্রতিবাদ করে বসে তার উপকারী বসের অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অন্যায়টা তারই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সহকর্মী এডিথের ওপর অন্যায় সন্দেহ ও অপমানের প্রশ্নে। আরতি বসকে ক্ষমা চাইতে অনুরোধ করে। অনড় বস কখনোই তার অধস্তন কর্মীর কাছে ক্ষমা চাইতে রাজি হলেন না, আরতি সেই রেজিগনেশন লেটারটা দিয়ে দেয় তখনই। অফিসের বাইরে এসে নিজের স্বামীকে দেখে আরতি সংকুচিত হ’য়ে যায়। কেননা, এই চাকরিটাই তার পরিবারের বেঁচে থাকার জন্য একমাত্র আয়ের উৎস ছিল! সত্যজিতের নিখুঁত মানবিক চিত্রায়ণ এইখানেই যে, এমন একটা হতাশার জায়গায় এসেও আরতিকে তিনি ভেঙে পড়তে দেননি, আপোস করতে দেননি, আরতি যেখানে বলে—এত বড় শহর, এত লোক...দু’জনের একজনও কি একটা চাকরি পাব না? এই পরিবারটার শেষ পর্যন্ত কি হ’ল? তারা বাঁচলো, না অনাহারে মরল, আমরা জানতে পারি না। কিন্তু আরতি ও তার স্বামী বড় রাস্তা পেরিয়ে জনসমুদ্রে মিশে যায়। আশার ইঙ্গিত এটাই। এ দেশের হাজার হাজার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের ঘরে পৌঁছে যাই আমরা। যেখানে অভাব ও নিশ্চিত পতন জেনেও মানুষ তার মানবিকতাকে ভোলেনা, ভোলেনা আত্মসম্ভ্রম। এ ছবির প্রাসঙ্গিকতা তাই চিরকালই বজায় থাকবে, যতদিন না অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকাঠামোর আমূল পরিবর্তন না হয়।
রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র করার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায় সবচেয়ে বেশি সফল। তাই রবীন্দ্রনাথের ““নষ্টনীড়” হ’’য়ে ওঠে সত্যজিতের ““চারুলতা””। এক অভিজাত শিক্ষিত অর্থবান পরিবারের তরুণী বধূ চারুলতার নিঃসঙ্গতা থেকে ক্রমে তার সমবয়সী দেওর অমলের প্রতি মানসিক নির্ভরতা গড়ে ওঠে। কেননা চারুর স্বামী ভূপতি ভালমানুষ, দেশের স্বাধীনতার কথা ভাবে, কাগজ বার করে, সব দিক থেকেই লিবারাল। কিন্তু সে স্ত্রীকে ভালবাসলেও, একেবারেই সময় বা সঙ্গ দেয় না। ছবির শেষে, যেখানে বিধ্বস্ত, প্রতারিত ভূপতি প্রথম স্ত্রীর কাছে আসে সহানুভূতির আশায়, তখন চারুলতার সঙ্গে তার মানসিক দূরত্ব বহু যোজন। চারুর সমস্ত মন জুড়ে তখন অমল। ভূপতি চারুর সুখী ঘর হয়ে যায় নষ্টনীড়। চারুর বাড়িয়ে দেওয়া হাত ভূপতি ধরতে যায়, কিন্তু সেখানে দূরত্ব রেখে দেয় পরিচালক। রেখে দেয় দর্শকের জন্য অসীম কৌতূহল, এরপর কী হবে? চারু, ভূপতি,অমল—এরা কেউই অপরাধী নয়, ভিলেন নয়। এই সামাজিক পটভূমিতে এরা তিনজনেই ভীষণ বাস্তব। অধিকারবোধ সম্পর্কে কেউই উগ্র নয়। এই পরিমিতি বোধটাই “চারুলতা”কে আবহমানকাল ক্ল্যাসিক হিসেবে কদর করবে দেশ ও কাল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিচারে এই প্রাসঙ্গিকতাকে উপেক্ষা করব কোন বিচারে, যখন রামমোহন রায় নব জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে চিহ্নিত, ভারতের ইতিহাসে! তার পাথরের মূর্তির মুণ্ডু কাটলেই সেই শতাব্দীর সত্যতা নিহত হয় না।
এ প্রসঙ্গে আসি ““কাঞ্চনজঙ্ঘা””র কথায়। ছবির নায়ক হ’ল একটি গোটা পরিবার। দার্জিলিঙে তারা বেড়াতে এসেছেন। একটি একটি ঘটনায় পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো পরিবারের এক একটি সদস্যের মনোজগত অনাবৃত করেছেন পরিচালক। যেখানে প্রায় সব কটি চরিত্রের আবর্তন-বিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করেছেন রায়বাহাদুর—পরিবারের কর্তা। অহংকারী, দর্পিত, কঠোর কখনও বা নিষ্ঠুরও। তাঁর কথাই শেষ কথা। বাকিরা যেন পুতুল তার হাতের। সেই রায়বাহাদুরের দেওয়া চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন বেকার যুবক। ছোট মেয়েও প্রত্যাখ্যান করে বাবার পছন্দ করা স্যুটারকে। ক্রমে ধোঁয়াশায় ঢাকা কাঞ্চানজঙ্ঘা ধীরে ধীরে নিজেকে প্রকাশ করে আনে, কুয়াশার জাল সরে যায়। ছবির অন্তপর্বে আমরা দেখি রায়বাহাদুর সবাইকে ডাকছেন—স্ত্রী, শ্যালক, কন্যা কিন্তু কারও বশংবদ সাড়া এসে পৌঁছায় না। কিন্তু প্রস্ফুটিত হ’য়ে ওঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা, যা এতকাল ছিল আড়ালে। এমন সুন্দর সৃষ্টি অত্যন্ত বিরল। বিষয়বস্তুর প্রাসঙ্গিকতায় হয়তো খুব সরল নয় ““কাঞ্চনজঙ্ঘা”, কিন্তু শিল্পীর স্বচ্ছ দৃষ্টি আমাদের চিনিয়ে দেয় যে চরিত্রগুলি, তারা পর্দায় সত্যজিতের সৃষ্টি হ’লেও ভীষণ ভীষণ বাস্তব ও রক্তমাংসের মানুষ। আরও উল্লেখযোগ্য হল ছবির কেন্দ্রস্থ চরিত্র কোনও ব্যক্তি বিশেষ নয়, একটি গোটা পরিবার ও কাঞ্চনজঙ্ঘা!
“তিনকন্যা”য় তিনটি গল্প তিন ধাঁচের। তিনটি মেয়ের সামাজিক অবস্থান ও বেড়ে ওঠাও একরকম নয়। “পোস্টমাস্টা”” গল্পের ছোট্ট অনাথ মেয়ে রতন গ্রামের পোস্ট মাস্টারের ফাই ফরমাস খাটতে খাটতে একসময়ে তাকে আপনজন ভাবতে থাকে। তার যেন দায়িত্ব বর্তে যায় শহর থেকে আসা বাবুর অসুস্থতায় সেবা করার। কিন্তু, শহরে বাবু শেষ পর্যন্ত রতনকে কি আপনজন ভাবতে পারে? পারে কি দায়িত্ব তার নিতে? এক অনিশ্চিতের মুখে ছোট্ট রতনকে ফেলে যাবার সময় তার দায়িত্ববোধ তাকে যন্ত্রণা দেয়—দ্বিতীয় ভাগটা শেখানো হয়নি! টাকা দিতে চায়—চলে যাবার সময় মনিবের বকশিশ! দরিদ্র দুঃখী অনাথা রতনের অসহায়তা সত্ত্বেও তীব্র অভিমান আমাদেরও কাঁদিয়ে দেয়। যখন দেখি সে ছোট ছোট হাতে নতুন মাস্টারের জন্য কুয়ো থেকে জল তুলে, ঈষৎ বেঁকে ভরা বালতি টেনে নিয়ে যায়। মানবিক দৃষ্টি না থাকলে এ দৃশ্য রচনা করা যায় না।
অন্যদিকে ““মণিহারা”” গল্পে ব্যবসায়ীর স্ত্রী মণিমালিকা কিন্তু জীবনে একমাত্র চিনেছিল গয়না ও মণিরত্ন! ভালবাসা, নির্ভরতা এসবের চেয়েও গহনা তার কাছে প্রাণাধিক প্রিয়! রতন যেমন দরিদ্র হয়েও দুঃখে অভিমানে মাস্টারের কাছে হাত পাততে পারেনা, মনিমালিকা সেখানে মৃত্যুর পরেও ফিরে আসে বিপর্যস্ত স্বামীর কাছে গহনা নেবার জন্য। হয়তো বিষয়টা কাল্পনিক। কিন্তু রতনের প্রতি আমরা বেশি দুর্বল হ’’য়ে পড়ি। “সমাপ্তি”” গল্পে গেছো আহ্লাদী মেয়ে মৃন্ময়ী কি করে নারীত্বে উপনীত হয় তার সরস চিত্রণ। অর্পূব স্ত্রীর ভালবাসা না পেয়ে চলে যায় শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য। কিন্তু এই অদর্শন ক্রমে মৃন্ময়ীর ভিতরে স্বামীর প্রতি প্রেমের উন্মেষ ঘটায়। এই মিলনেই ““সমাপ্তি” ঘটে চঞ্চলা মৃন্ময়ী বারমুখো স্বভাবের। এই তিনটি চরিত্রই বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আজও বর্তমান। পরিচালক শুধু আঙুল দিয়ে এদের পরিণতিটাকে আশাব্যঞ্জক দিকে পরিচালিত করার জন্যই যেন দেখিয়ে দিয়েছেন।
পরিশেষে বলি, যাঁরা যথার্থ চলচ্চিত্র সমালোচক, সমঝদার, সমাজ সচেতন, এমনকি সমাজতান্ত্রিক দর্শনের নিরিখে ছবি দেখছেন, নিরপেক্ষভাবে তিনি লক্ষ করেন, তাহলে দেখবেন ““সদগতি”” থেকে ““আগন্তুক”” (শেষ ছবি), সত্যজিৎ রায় ক্রমশ জন সাধারণের সামনে তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর হয়ে পড়েছিলেন এই সমাজের দুনম্বরী বা ভয়াবহ অবক্ষয়। আমাদের এই সমাজ ও বিভিন্ন শ্রেণীর, বিশেষত যাঁরা নিজেদের অভিজাত ও ধনী ভাবেন, চালচলনে, সর্বদা নিজেদের নিজেদের শ্রেণী অহংকার প্রাত্যহিক আচরণেও জড়িত—সেটা হল এক নম্বরী আর পিছনে অর্থাৎ আড়ালে দু’নম্বরীটাই মূলত জড়িত।—যা আজকের সমাজে মানুষের মুল্যবোধকে ক্রমশ রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে এবং তার অকাল প্রয়াণের ফলে তাঁর যে সব গল্প নিয়ে ছবি করার স্বপ্ন ছিল, যেমন, ““বিছন”—(লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী), “আকাশের নীচে মানুষ”” (লেখক প্রফুল্ল রায়), ““টার্গেট”” (লেখক প্রফুল্ল রায়)—সেগুলো আমরা আর পেলাম না; পাবও না। এর চেয়ে বড় ক্ষতি, অন্তত ভারতীয় তথা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে আর কি থাকতে পারে? নিজেকে বিপ্লবী না বলেও বৈপ্লবিক পরিস্থিতির অভাব থাকা সত্ত্বেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, ক্যামেরা, চিত্রনাট্য এবং সংলাপ কিন্তু ওই দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল! কাজেই, প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নে ঋত্বিক ঘটকের সৃষ্টিকেও স্বীকার করতে হয়। কিন্তু যে সমস্যা নিয়ে তিনি একের পর এক ছবি করে গেছেন, তার মূল বিষয় পার্টিশন, বাংলা ভাগের প্রভাব, কুফল, হাজার হাজার মানুষের হাহাকার! কিন্তু সত্যজিতের সঙ্গে তফাৎ হ’ল এই, সত্যজিৎ সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে, কখনও এই শতাব্দীর মধ্য ভাগ, কখনও ঊনবিংশ শতাব্দী, কখনও একেবারে হাল আমলের দু’নম্বরী সমস্যা নিয়ে ছবি করে গেছেন। অর্থাৎ তাঁর ছবির সামাজিক প্রাসঙ্গিকতায় ছিল বৈচিত্র্য, সংযম, সঙ্গীতের যথার্থ প্রয়োগ এবং ওই আই.পি.টি.এর নাটুকেপনা বা মেলোড্রামা একেবারেই নেই তাঁর কোনও ছবিতে। তাই সত্যজিৎ সত্যজিৎই—অমন প্রতিভার তুলনা একমাত্র তিনি নিজেই। এদেশে তো কেউ নেই-ই, বিদেশেও তেমন বেশি নয়, অন্তত শেষ দিকের ছবিগুলো দেখলে বোঝা যায়। তাই ““অস্কার”টাও ভীষণভাবেই প্রাসঙ্গিক!
আগেই বলেছি, ছবির বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গীতের যোগাযোগ কতটা। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রবন্ধের একটি অংশ উল্লেখ করছি : ““চলচ্চিত্রে পরিচালক ছাড়া তার ছবির আবহসঙ্গীত কী হবে, সেটা তার চেয়ে কে বোঝে?”” বলা বাহুল্য, সেটা সত্যজিৎ রায় বুঝতেন বলেই তিনি সার্থক, চিরন্তন। এই উক্তিটি যে কত বড় সত্য, কতটা মূল্যবান তা সত্যজিৎ নিজেই প্রমাণ করে দিয়েছেন “তিন কন্যা”” থেকে ““আগন্তুক”” পর্যন্ত। “তিন কন্যা”র” আগে পর্যন্ত তিনি কোনওরকম আবহসঙ্গীত বা গান তাঁর ছবির জন্য তৈরি করেননি। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সত্যজিৎ প্রমাণ করলেন, আমাদের শেখালেন এক মহামূল্যবান শিক্ষা। সেটা হল, চলচ্চিত্র যেমন তার নিজস্ব ভাষা বা language ছাড়া উত্তীর্ণ হতে পারেনা, সে যতবড়ই ক্ল্যাসিক গল্প নির্বাচন করা হোকনা কেন, সেটাকে চিত্রনাট্যে রূপ দেওয়ার জন্য তার পরিবর্তন অপরিহার্য, কেননা, সেটাকে চলচ্চিত্রের ভাষায় রূপান্তরিত করতে হবে, অবশ্যই গল্পের মূল বক্তব্য, চরিত্র ও পটভূমিকে বজায় রেখে। ফলে, তিনি, চলচ্চিত্রের নিজস্ব যে ভাষা, তার সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করেই ঠিক চলচ্চিত্রের চাহিদা অনুযায়ী আবহসঙ্গীত রচনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন এবং সে ক্ষেত্রেও যে ব্যতিক্রমটি ঘটালেন সেটা হল ভারতবর্ষ তথা আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে এলেন, ছবির স্বার্থে, (তাঁদের নামের স্বার্থে নয়), অপু ট্রিলজির জন্য পণ্ডিত রবিশংকর,““জলসাঘর””-এর জন্য বিলায়েৎ খাঁ,“দেবী”তে আলি আকবর খাঁ, আবার “পরশ পাথর””র জন্য রবিশংকরকে।
এঁরা সকলেই বিশাল পণ্ডিত আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে। তাঁদের সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন তোলার ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু, এঁরা আরও অনেকের ছবিতে তো আবহ সঙ্গীত রচনা করেছেন, সেগুলো কেন অপু ট্রিলজি, ““দেবী”, ““জলসাঘর” বা “পরশ পাথর””র মতো মাস্টার পিস হয়নি? বিষয় একটাই, পরিচালক কে? তিনি তাঁর ছবির মুড ও সিচুয়েশনের দাবিতে সঙ্গীত আদায় করে নেবেন, কাজে লাগাবেন। তবেই তো তিনি যথার্থ পরিচালক। আর, এই কাজটি করতে গেলে যেটা সর্বাগ্রে প্রয়োজন, সেটা হল, কী প্রাচ্য, কী পাশ্চাত্য—উভয় সঙ্গীত সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশোনা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। তিনি আমায় বলেছিলেন, “ইনফ্যাক্ট, মিউজিক ওয়াজ মাই ফার্স্ট লাভ। তাছাড়া, আমার পরিবারে কি ঠাকুর্দ্দার দিক থেকে কি মায়ের দিক থেকে, পরে পরে এমন কেউ ছিলেন না যে গান জানতেন না, করতেন না বা বুঝতেন না। ... ফলে গানের ব্যাপারটা আমার রক্তের মধ্যেই ছিল! ...ইনফ্যাক্ট, মিউজিক করতে, গান লিখতে, সুর করতে ভীষণ, মানে কী বলব, দারুণ ভাল লাগে। কিন্তু সে সুযোগ তো বার বার আসেনা—এই যা! মানে, গানের কথা বলছি।”
“তিন কন্যা”” থেকে আবহ সঙ্গীতে হাত দিলেন কেন? মানিকদার জবাব—“আসলে এঁরা অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে থাকতেন, তাছাড়া আর একটা সমস্যা হত—এদের যদি ৩০ সেকেন্ড বা ২০ সেকেন্ডের পিস কম্পোজ করে বাজাতে বলতাম, ওঁরা সেটা ৩/৪ মিনিট বাজিয়ে ফেলতেন, ফলে আমাকে এডিটিং টেবিলে বসে ঘষে মেজে কেটে কুটে জুড়তে হতো। এটা করতে করতে আমার মনে হ’ল, ফাইনালি যখন কাজটা আমিই করছি, তাহলে ওঁদের অপেক্ষায় না থেকে, আমিই আবহ সঙ্গীত রচনা করি! তারপর তো হয়েই গেল!”
সত্যজিৎ বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভাষা বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে আবহ সঙ্গীতেও একটা নতুন দিক নির্দেশ করলেন। তাঁর অধিকাংশ ছবিতেই ঘুরে ফিরে আসে একটি থিম মিউজিক—ঠিক বিশেষ মুহূর্তে বা তাঁর ভাষায় Just to underline the mood of the situation. যেমন “পথের পাঁচালি””র সেই ঘুরে ফিরে আসা বাঁশী আর সেতার। অধিকাংশ ছবিতেই এটা পাওয়া যায়। যেমন ““তিন কন্যা”র মণিহারা গল্পে “বাজে করুণ সুর ...” গানটির ব্যবহার বা ভাবুন তো পোস্টমাস্টারে সেই গ্রাম্য লোকেদের সঙ্গীত রসের নমুনা, সেই যে দাঁতখসা বৃদ্ধ গানটি গাইছিলেন? কতটা জীবন্ত—নিছক গ্রাম্য কায়দায় রাগভিত্তিক গান এবং তার গায়কী এবং ভঙ্গিমায়, শুধু হাসায় না, ভাবায়ও?
“সমাপ্তি””তে যখন মৃন্ময়ীর প্রেমে পড়েছে অপূর্ব, তখন কোনও “আবহ সঙ্গীত” নেই, সেই পুরানো আমলের কলের গানে বাজছে সেই অতি সাবেকি রেকর্ড “বসিয়া বিজনে কেন একা মনে ...!” কিন্তু দূরন্ত বেয়াড়া মেয়ে মৃন্ময়ী যখন তার পায়ের নুপুর খুলে রাখে কলের গানের চোঙ্গের মধ্যে, তার আগে রেকর্ডের ডিসকটার ঘুরে যাবার শব্দ। কোনও গান নেই। তারপর যেন মুক্তি পেল মৃন্ময়ী। ছাদ টপকে যখন তার আদরের কাঠবিড়ালী চরকির কাছে ছুটে আসে, তখনকার মিউজিক হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, রানার আসছে দেখে। রানার চলে যাওয়া মাত্র যখন রথের ওপর চড়ে চরকিকে আদর করে দোলনায় দোলে, যেন খাঁচা থেকে মুক্ত পাখির আনন্দে দোলনায় দুলতে থাকে। তখন যে আবহ সঙ্গীত বাজতে থাকে, তা দর্শককে ভিশুয়ালি এবং মিউজিক্যালি দুলিয়ে দেয়। “চারুলতা”য় টাইটেল মিউজিক “মমচিত্তে নিতি নৃত্যে ...”” কী অসাধারণ ভাবনা বা কম্পোজিশন! বা, বই খুঁজতে খুঁজতে চারুর কণ্ঠে “বঙ্কিম বঙ্কিম”! চারু যখন অমলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গল্প লেখার চেষ্টা করে তখনকার আবহ সঙ্গীত মোৎসার্টকে মনে করিয়ে দেয়। মুগ্ধ করে, চারু যখন তার গল্পের খোরাক পায় দোলনায় বসে তার গ্রামের স্মৃতি থেকে—সেই সময়কার ভিশুয়াল এবং মিউজিক এবং তারপর গল্প লেখা।
কিম্বা “আমি চিনি গো চিনি তোমারে...”” গানটি ব্যবহারে দেওর-বৌদির রঙ্গ রসিকতার ভঙ্গিমায় বা যখন মন্দা’র বর ভূপতির সিন্দুক ভাঙ্গার প্ল্যান করে, তখন যে গানটি ব্যবহৃত হয়, ছবির মুডকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া, ছবির মাঝে “ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে ...” ” কতবার যে ঘুরে ফিরে আসে। অমল-চারুর ঘনিষ্ঠতার মাঝে মাঝে। ““কাঞ্চনজঙ্ঘা” ছবিতে আবহ সঙ্গীতের চেয়ে পারিপার্শ্বিক শব্দ বা sound effect সমান গুরুত্ব পেয়েছে। ঠিক বার্গম্যানের ছবিতে যেমন মিউজিক খুব কম পাওয়া যায়, তেমনি,““কাঞ্চনজঙ্ঘা”, ““মহানগর”, ““অরণ্যের দিনরাত্রি”, ““প্রতিদ্বন্দ্বী”, ““জন অরণ্য”, “সদগতি”, ““শাখা প্রশাখা”, ““আগন্তুক”, ““পিকু”” এসব ছবিতে তাঁর আগের ছবির মতন মিউজিক তেমন প্রাধান্য পায়নি, বরং গুরুত্ব পেয়েছে এফেক্ট, অর্থাৎ ধ্বনি। যেমন, ““কাঞ্চনঙ্ঘা”য় যেখানে রায় বাহাদুরের কন্যার জন্য নির্বাচিত স্যুটার, কিছুতেই রায় বাহাদুরের কন্যার অর্থাৎ মনীষার সায় পাচ্ছেনা—তখন ক্রমশ একরাশ মিউলের ঘণ্টার শব্দ তীব্র হ’তে হ’তে দূরে মিলিয়ে যায়, সেই ক্লাইম্যাক্স এরপর কোনও মিউজিক বা সংলাপের প্রয়োজন পড়েনা। আসলে কি ছবির কাঠামোর ক্ষেত্রে কি আবহ সঙ্গীত বা গান ব্যবহারের ক্ষেত্রে সত্যজিৎ প্রসঙ্গে একটি শব্দ বার বার মনে পড়ে “সংযম”” বা restrainment এবং সঙ্গতি বা consistency, কোথাও মেদ থাকে না।
যেমন, যেখানে মনীষাকে আর তার স্যুটার আয়ত্বে আনতে পারলো না, তখন স্যুটার মনীষার জন্য আনা চকোলেটটা একটি ভিখিরি ছেলের হাতে দিয়ে বলে : ““নে তোরই জিৎ!” ভিখিরিটি প্রথমে ভিক্ষা চেয়ে পায়নি। চকোলেটটি পেয়ে সে পরম খুশিতে আনন্দে খেতে খেতে পাহাড়ি ফোক গান গাইতে থাকে। সেটা লক্ষ্য করেন রায়বাহাদুর, যখন তার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট ফিউডাল আত্মঅহমিকা এবং এতো দিন ধরে তার পরিবারের ওপর কম্যান্ডের সব কর্মকাণ্ড ছারখার, সবাই তাকে ছেড়েছে, তিনি সকলের নাম ধরে ডাকছেন, কিন্তু নিঃসঙ্গ, কারও সাড়া পাচ্ছেন না! তখন তুষারাবৃত মেঘ সরে যেতে থাকে, প্রকাশ পেতে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ঝলমলে সেই বিশাল গম্ভীর ব্যক্তিত্বপূর্ণ চূড়া—তখন সত্যজিৎ ওই নেপালী লোক সুরটিকে (ভিখিরির গান) Western tune এর সঙ্গে ব্লেন্ড করেন। এটাই তার সঙ্গীত চেতনার সব চেয়ে বড়গুণ যে ঠিক রবীন্দ্রনাথ, রবিশঙ্করের মতন western music এবং ভারতীয় সুরকে সুন্দরভাবে মিশ্রণ ঘটাতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথের গানকে improvise করে music করে গেছেন যেখানে, সেখানেও সত্যজিতের মৌলিকত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। আবার রাবীন্দ্রিক মেজাজটাও হারায়নি কখনও।
“রবীন্দ্রনাথ” তথ্যচিত্র এর আর একটি বড় উদাহরণ। ছবির শুরু ও শেষ যেভাবে হয়, তা ভোলার না, মনে হয় সত্যজিতের জন্যই যেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর যথার্থ পরিচিত পেলেন—এই art form এর মাধ্যমে, এটা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কেউ করলে কী দাঁড়াতো, সেটা ভাবলেও ভয় হয়! মনে পড়ে “পরশ পাথরে”” পরশ পাথরটি পাওয়ার পর পরেশবাবুর বউ-এর গলায় গান/ বা ““পোস্ট মাস্টারে” রতনের গান/ বা চারুর গলায় ““ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে”” (বিজয়া রায়ের কণ্ঠে) গান। বাস্তব জীবনকে নিয়ে ছবি করেছেন তাই সত্যজিতের ছবিতে (বাচ্চাদের ছবি বা ফেলুদা ছাড়া), কোথাও কখনও দেখলাম না যে যিনি গান গাইছেন তার সঙ্গে তবলা, সেতার, সরোদ, বেহালা বা সারেঙ্গী বাজছে, কেননা, বাস্তবে সেটা একেবারেই অসম্ভব! অথচ, যখন প্রয়োজন হয়েছে ছবির চাহিদায় তখন খোদ “বেগম আখতার”, ““সলামৎ আলি””কে দিয়ে গান গাইয়েছেন ““জলসাঘরে””। এমনকি রোশন কুমারীকে এনেছেন ডেকাডেন্ট ফিউডাল লর্ড এর ইগোর টানে। আবার ওই “জলসাঘরে””ই শেষ দৃশ্যে যখন জলসাঘরের সব আলো নিভে যাচ্ছে, বিশ্বম্ভর কাঁদো কাঁদো স্বরে বলছেন—অনন্ত, সব নিভে গেল! নিভে গেল!”—ওই সময়কার পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রেশনের তুলনা নেই। চায়কভ্স্কির কথা স্বরণ করিয়ে দেয়। বা “ঘরে বাইরে””তে ““একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ” গানটিকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন, বার বার শুনতে ইচ্ছা করে। বা পিকুর আঁকার খাতা হাতে নিঃসঙ্গভাবে বাগানে ঘুরে বেড়ানো—তখনকার মিউজিক প্রথমে পিয়ানো, তারপর বাঁশি, তারপর সিন্থেসাইজার মাত্র তিনটে যন্ত্রের কী অসাধারণ কম্পোজিশন, তাই Music of satyajit ray তথ্যচিত্রটি আমি করেইছিলাম এই তাগিদে, এই শ্রদ্ধায়। যেখানে সত্যজিতের বক্তব্য ছিল : I am using music less less and less.“আসলে music টা ব্যবহার না করতে পারলেই খুশি হতাম! কারণ এখনকার জীবন এত fast, এত pollution, সেই পায়রার গোঙানিও শোনা যায় না, বাসনওলাও থালা বাজিয়ে যায়না, আতাফলের ডাকও শুনিনা, যেটা take করার জন্য আমার মনে আছে আমি north Calcutta প্রায় ৫/৬ দিন কাটিয়েছি! কোথায় পাবে তক্ষক সাপের ডাক? কিন্তু মুশকিল কি জানো, দর্শককে তো মানতে হয়, ফলে তাদেরকে drama টাকে underline করে দেখাবার জন্য music টা ব্যবহার করতে হয়!” হেসে আমি বলেছিলাম : দর্শক যেন চিরকালই চায় আপনি music করুন। উনি হেসে বললেন : ““ওটা দর্শকের উত্তর, না তোমার বাসনা?”” আমি নীরবে হাসলাম। সত্যি, দর্শকের নামে আমি চেয়েছিলাম, মানিকদা যেন একেবারে music টা off করে না দেন। কারণ ““সদগতি”তে music এর আশ কতটুকু! যে মানুষটা পাশ্চাত্যে কায়দায় notation করতে জানেন, প্রত্যেকটা instrument এর ব্যবহার জানেন, এদেশের ধ্রুপদী সঙ্গীত এবং পাশ্চাত্যের বাখ, বিঠোফেন, চায়ক্ভস্কি মোৎসার্ট গুলে খেয়েছেন, এবং শুনেছি শিশ্ দিয়ে প্রত্যেকটা গানের হুবহু সুর শোনাতেন এবং প্রয়াত দূর্গাদাস মিত্র আমায় বলেছিলেন “কাঞ্চনজঙ্ঘা””য় কয়েকটা scene এ shooting এর সময় পাখির শব্দ তেমন ধরা পড়ছিল না sound recorder এ মানিকদা নিজে মুখ দিয়ে ওই পাখির শব্দ নকল করেছিলেন। ফলে, এমন বহুমুখী প্রতিভাধর পরিচালকের কাছ থেকে তাঁর ছবিতে music বা গান পাব না, তা ভাবা যায়! তিনি অবশ্য সেটা করে গেছেন। আর, গানের সুর? ““চিড়িয়াখানা” ছবিটা আমায় টানেনি, কিন্তু ওই ঊনবিংশ শতাব্দীর মুডে তিনি একটি গান লিখেছিলেন এবং সুর দিয়েছিলেন—“ভালবাসার তুমি কি জানো!””—গানটি গেয়েছিলেন নমিতা ঘোষাল। কে বলবে—ওটা ওই সময়কার গান নয়! আবার ““দেবী”তে একটা রামপ্রসাদী সুরে স্বরবিত্ত গান ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। আর, “গু গা বাবা” ছবির বহু আগে কয়েকটি গান লেখেন এবং সুর দেন। তখন চিত্রনাট্যও লেখা হয়নি। সুরগুলো এবং কথাগুলো যখন মনোমতন হল, তখন তিনি চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করলেন। সুরের বৈচিত্র্য এবং মাহাত্ম্যটি কোথায়? ““দেখোরে নয়ন মেলে ...”” ভোরের বেলায় গুপী নতুন সুরের বর পেয়ে গান গাইছে : গানটি লক্ষ্যনীয় ভৈরবী রাগের ওপর আধারিত। আরও উল্লেখ করতে হয় ““হীরকরাজার দেশে”তে “পায়ে পড়ি বাঘমামা”—কর্নাটকী ঢঙে সুর করেছেন—ব্যবহার করেছেন দক্ষিণী বাদ্যযন্ত্র, বীণা ইত্যাদি। এটা অন্য সুরে গাওয়া হচ্ছে, ভাবা যায়?
প্রথম দক্ষিণী সুরের প্রয়োগও করেছিলেন “গুপী গাইন বাঘা বাইন”’ ছবির গানে। মিউজিকের ওপর দখল না থাকলে এরকম দুটি মিউজিক্যাল ছবি সাফল্যের সঙ্গে কখনওই করা সম্ভব হ’তনা। যখন ছবি করার কথা ভাবি, চিত্রনাট্য লিখি, সঙ্গীত কম্পোজ করি, গানে সুর দিই, তখন বার বার মনে হয়, যাই একবার, কিন্তু কিন্তু করে বলি—মানিকদা, সুরটা কি ঠিক আছে, কথার সঙ্গে সুরের সাযুজ্য থাকছে? আমি যে শুদ্ধ নি’টা জানি, তাই যন্ত্রণাটা বেশি! আর এই কারণেই মানিকদার ছবি প্রাসঙ্গিকতা ও সঙ্গীত চিরন্তন একা institution, আমি যতটুকু শিক্ষা নেওয়ার, ওখান থেকেই নিই। উনি নিজে নকলনবিশ ছিলেননা, তাই আমিও ওঁর শিক্ষা মাথায় রাখি, শ্রদ্ধা সহ। কাজটা করি নিজের ভঙ্গিমায়।
শেষ করার আগে একটি কথা না বললে আমার তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমার “চোখ” ছবি দেখে উনি সংযত ভঙ্গিমায় প্রশংসা করে,“চোখ””-এর মূল টাইটেলটা লিখে দিয়েছিলেন এবং মন্তব্য করেছিলেন—“শ্যামানন্দ জালানকে দিয়ে খুব ভাল কাজ করিয়েছো। কিন্তু একটা সংলাপে একটি শব্দ, আমার কানে লেগেছে!”—“কোনটা মানিকদা?”” আমি অধীর আগ্রহে তাকিয়ে।—“না না সাংঘাতিক কিছু না ওই যে বলল না”—“আমার ওই চোখদুটো প্রয়োজন। ওই প্রয়োজন শব্দটা—শুদ্ধ আর কি, ওখানে দরকার শব্দটা বসালে অনেক বেশি কলোকাল ব্যাপার হত আর কি? বোঝাতে পারলাম?”
কতবড় মাপের মানুষই তো ছবিটা দেখেছেন আর উনি অতবড় ছবিটার মধ্যে ওই একটা শব্দ ঠিক নোট করেছেন! তার মানে কতটা নজর দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখেছেন! তারপর উনি বললেন। “শোন ““কান””, মানে কানটা খুব পরিষ্কার রাখতে হবে। কানটা পরিষ্কার থাকলে সংলাপটাও ভাল শোনা যায়, বোঝা যায়, আর সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ওটা তো ভীষণ দরকার!”
এই শিক্ষা কে দেবে? কার কাছে এই শিল্প চেতনা পাব, বিশেষ করে এই দেশে? তাই আমার ব্যক্তিগত মতে, এই ঘটনাটাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক!
লেখক : উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব। তার জন্ম ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায়। উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে—ময়না তদন্ত (১৯৮০), চোখ (১৯৮৩), দেবশিশু (১৯৮৫), ফাঁসি (১৯৮৮), প্রসব (১৯৯৪); প্রামাণ্যচিত্র : দ্য মিউজিক অব সত্যজিৎ রায় (১৯৮৪), দেব্রত বিশ্বাস (১৯৮৩), মুক্তি চাই (১৯৭৭), সুনীলো সাগর (অন দ্য লাইফ অব সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)।
দায়স্বীকার : এই প্রবন্ধটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত দুলেন্দ্র ভৌমিক সম্পাদিত ‘আনন্দলোক’ পূজাবার্ষিকী ১৪০৪ বঙ্গাব্দ থেকে নেওয়া।
মতামত
এই লেখায় মতামত দিতে লগ-ইন অথবা নিবন্ধন করুন ।