চলচ্চিত্রের বর্তমান » হিরো আলম ‘রোদ্দুর’ হতে চেয়েছিলো
হিরো আলম ‘রোদ্দুর’ হতে চেয়েছিলো
কোনো গবেষণা কিংবা জরিপের ফল নয়; একেবারে ব্যবহারিক জীবনে মানুষের সঙ্গে মিশতে গিয়ে দেখেছি, ফেইসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সম্পর্কে সমাজে ইতি-নেতি দু’ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিই আছে। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির একটা যুক্তি হলো বিচ্ছিন্নতা; তা মানুষ থেকে মানুষের হোক, কিংবা মতাদর্শ থেকে আরেক মতাদর্শে বিচ্যুতিই হোক। আবার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির যুক্তি হলো, মূলধারার গণমাধ্যম যা পারে না, যা করে না, তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম করতে পারে। মূলধারার গণমাধ্যম যা (একটা সময় পর্যন্ত) পাত্তা দেয় না, অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তা আলোচ্য করে তোলে—এমন একটা উদাহরণ হিসেবে আপাতত হিরো আলমকে এই আলোচনার দৃশ্যপটে আনা।
এখন আমার প্রশ্ন—সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আবিষ্কার এই হিরো আলমকে কী বলবো? এটা কি এই মাধ্যমের ইতিবাচক, নাকি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের ফসল? কিংবা হিরো আলম সম্পর্কে যে ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে, তা নির্ধারিত, নাকি আরোপিত? আবার এটাও জানতে চাই, হিরো আলমকে জন্ম দিলো কে? তিনি ‘প্রতিবন্ধী’ হলেন কীভাবে? তিনি কি জন্মগতভাবেই ‘প্রতিবন্ধী’? নাকি ‘স্বাভাবিকতা’র আধুনিক কোনো সংজ্ঞায় তিনি ওই শ্রেণিতে পড়েন?
‘প্রতিবন্ধী’ কোন অর্থে, তা আলোচনার ধারাবাহিকতায় পরিষ্কার হওয়ার কথা। তবে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, সবগুলোর উত্তর বর্তমানের ‘আধুনিকতার’ সুড়ঙ্গে চোখ রেখে খুঁজতে চাই।
২.
যাকে নিয়ে এ আলোচনা, সেই হিরো আলম সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা জরুরি।
ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে আলমের ভিডিও ও ছবি। কিন্তু কে এই হিরো আলম? সিডি বিক্রি করতেন আশরাফুল আলম। সেটা বেশ আগের ঘটনা। সিডি যখন চলছিল না ঠিক তখনই মাথায় আসে ক্যাবল নেটওয়ার্ক ব্যবসার। ভাবলেন নিজ গ্রামেই সেটা করবেন, এবং করে ফেললেন। বগুড়ার এরুলিয়া ইউনিয়নের এরুলিয়া গ্রামেই শুরু হয় আলমের ডিশ ব্যবসা।
ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটনের সাথে চলা আলমের পরিবার তাকে আরেক পরিবারের হাতে তুলে দেয়। আলম চলে আসেন একই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের বাসায়। আব্দুর রাজ্জাক তাকে ছেলের মতো করেই বড় করে তোলেন। স্নেহ করতেন। কিন্তু গ্রামে অভাব তো প্রায় মানুষেরই আছে। আলমের পালক পিতা আব্দুর রাজ্জাকের সংসারও অভাবের ছোঁয়া পায়। স্থানীয় স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে আলমকে নেমে পড়তে হলো জীবিকা নির্বাহের তাগিদে। সিডি বিক্রি থেকে আলম ডিশ ব্যবসায় হাত দিয়ে সফলতা অর্জন করেন। তার মাসে আয় ৭০-৮০ হাজার টাকা। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সুখেই আছেন আলম।
সিডির ব্যবসা করতেন আলম। ক্যাসেটে দেখতেন মডেলদের ছবি। সেই থেকে মাথায় ঢোকে মডেল হওয়ার। ২০০৮ সালেই করে ফেলেন একটি গানের সাথে মডেলিং। সেটাই ছিল শুরু। এরপরে সেসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সংসারে মনোযোগী হন। ২০০৯ সালে বিয়ে করেন পাশের গ্রামের সুমি নামের এক তরুণীকে। আলম সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও সুমি পড়েছেন এসএসসি পর্যন্ত। তাদের সংসারে আসে নতুন দুই অতিথি। নিজের নামের সাথে মিলিয়ে রাখেন সন্তানদের নাম। পুত্র আবির ও কন্যা আলো। এখন সংসার আর ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত আলম। পাশাপাশি নিজে কিছু মিউজিক ভিডিও করেন। সেগুলো নিজের ক্যাবল চ্যানেলেই প্রচার করেন। গ্রামের মানুষরাও তাকে বাহবা দেন। আলম উৎসাহ পান।১
এর বাইরে আরো কিছু তথ্য আছে আশরাফুল আলম তথা হিরো আলম সম্পর্কে। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, নিজের পরিচালনায় তিনি এখন পর্যন্ত কয়েকশো মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করেছেন; এটা একটা পর্যায়। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর আরো কিছু অর্জন জোটে আলমের কপালে। যেমন : এখন তাকে বগুড়ার এরুলিয়া গ্রাম কিংবা ক্যাবল লাইনের বাইরেও অনেকে চেনে। ইউটিউবে তার মিউজিক ভিডিওর ভিউয়ার (দর্শক) বেড়েছে। এখন অনেক টেলিভিশন চ্যানেল তার সাক্ষাৎকার নেয়। একটি টিভি বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছেন তিনি। আমন্ত্রণ পান অনেক অনুষ্ঠানে। কিন্তু এগুলো তার কাজের পুরস্কার, নাকি তিরস্কার—সে প্রশ্নটাই মৌলিক।
৩.
এখন আসা যাক, হিরো আলমের নায়ক হওয়ার প্রচেষ্টা প্রসঙ্গে। এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, হিরো আলম হিরো হতে চান। কিন্তু তিনি তো জানেন, তিনি এখন পর্যন্ত যে ধরনের নায়ক হতে পেরেছেন; সেটিই চূড়ান্ত নায়ক নয়। অর্থাৎ, রাজ্জাক, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, সালমান শাহ, মান্না ও শাকিব খান প্রমুখ যে অর্থে নায়ক, তিনিও সে অর্থে নায়ক হতে চেয়েছিলেন কিংবা এখনো চাইছেন। কিন্তু তিনি সেই নায়ক হতে পারেননি।
কেনো হতে পারেননি? কারণ তার ইচ্ছা বা স্বপ্নগুলো সমাজের স্বপ্ন-বাস্তবায়ন কমিটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন, হিরো আলম উপলব্ধি করতে পারেন, তার এই চেহারাকে সমাজ কোনোভাবেই নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেবে না। আবার ক্ষমতাকাঠামোতে তার এমন কোনো সম্পর্কও নেই, যা ধরে উপরে ওঠা যায়। কিন্তু এতো সব প্রতিবন্ধকতার পরও কেনো নিজেকে হিরো হিসেবে দেখতে চান আলম? এর কারণ, প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি কিছু বাস্তবতাও হয়তো হিরো আলমের সামনে ছিলো। তিনি হয়তো দেখেছেন, ‘সুদর্শন’ না হওয়ার পরও জসিম নামে এক প্রতাপশালী নায়ক এই ঢাকাই বাংলা চলচ্চিত্রেই রাজত্ব করে গেছেন। নায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন অনন্ত জলিল। তাহলে ‘আমি আলম’ হিরো হতে পারবো না কেনো? মোটাদাগে মনে হয়েছে, এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই হয়তো আশরাফুল আলমের ‘হিরো আলম’ হওয়ার যাত্রা শুরু। আর এ যাত্রার অংশ হিসেবেই এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক মিউজিক ভিডিও বানিয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রতিবন্ধকতার বাস্তবতাও হিরো আলম এড়াতে পারেননি। এই বাস্তবতা তাকে আটকে রেখেছে এলাকার স্যাটেলাইট ক্যাবল লাইনের মধ্যে। নায়িকা হিসেবে বেছে নিতে হয়েছে যাত্রাপালা কিংবা স্থানীয় কোনো নারীকে, যারাও হয়তো নায়িকা হওয়ার স্বপ্নের স্রোতে ভাসতে গিয়ে নানা বাস্তবতার ধাক্কা খেয়ে হিরো আলমের সঙ্গে একই ঘাটে মিলিত হয়েছে। ফলে হিরো আলম কিংবা তার নায়িকারা সমাজ-রাষ্ট্রের নানা বাধার কারণেই ভিন্ন কোনো মোহনায় মিলিত হয়েছেন।
হিরো আলমকে নিয়ে যখন লেখার সিদ্ধান্ত নিই, তখন থেকেই ভিতরে প্রশ্ন ওঠে, পুঁজি প্রাধান্যশীল সমাজে নায়কের যে সংজ্ঞা, তাতে হিরো আলম খাপ খায় না—এটা ঠিক। অবশ্য খাপ খাওয়ার কথাও নয়। কিন্তু পুঁজির প্রভাব উপেক্ষা করে যদি নায়কের আদর্শ কোনো সংজ্ঞা বানানোও যায় (আদৌ সম্ভব নয়), তবে সেই সংজ্ঞাতেও কি হিরো আলম নায়কের বাছাই প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হতে পারবেন? হিরো আলমের নির্মিত মিউজিক ভিডিওগুলো দেখার পর এর উত্তর আসে নেতিবাচক। তাহলে কি হিরো আলমের নায়ক হওয়ার স্বপ্ন অন্যায়, ভুল? না; অন্যায় বা ভুল—কোনোটাই না। বরং হিরো আলম হওয়ার স্বপ্ন একটা বাস্তবতা। তার স্বপ্নের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবারও বলছি, এটা একটা বাস্তবতা। তাই হিরো আলমকে বিচার করতে গেলে সবার আগে জেরা করতে হবে বাস্তবতাকে। বাস্তবতা কেবল আজকের দিনের ঘটনা নয়। এটা গতকালের ঘটনার সিলসিলাও বটে।
৪.
কলকাতায় এমনই এক বাস্তবতা অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভাষাবিদ কলিম খান লিখেছেন,
স্বাধীনতা লাভের পর কলকাতার হাতে ছিল তিনরকম যজ্ঞের কৃতি-সংস্কৃতির প্রবাহ। গ্রাম বাংলা তাকে পাঠাত ফিউডাল প্রোডাক্ট ও কালচার, বিদেশ থেকে আসত বুর্জোয়া পণ্য ও সংস্কৃতি এবং সমাজতান্ত্রিক পণ্য ও সংস্কৃতি। ফলে, দেশগঠনের জন্য তার সামনে তিনরকম যজ্ঞের মডেল ছিল এবং স্বভাবতই ঐ মডেলগুলি ছিল পরষ্পরের বিরোধী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ফলাফল, ১৯৬০ সালের মধ্যেই, সেই সমস্ত মডেল গুলিকেই সেকেলে এবং পরিত্যাজ্য বলে ঘোষণা করে দিল। যেটুকু যা অবশিষ্ট ছিল, সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ধ্বসে যাওয়ার পর তাও গেল। ওদিকে গ্রামবাংলা বিরাণভূমি হতে থাকায় তার সাংস্কৃতিক নিম্নচাপের টান এসে পড়ল কলকাতার ওপর। গ্রামবাংলা বলল : মাছ নেবে, ধান নেবে? নাও! কিন্তু বদলে নাচ গান দিতে হবে। কলকাতা পড়ে যায় মুশকিলে। যে দু-চারটি নিজস্ব আধুনিক শিল্প সে সৃষ্টি করতে পারল, সেই কর্মযজ্ঞ থেকে উঠে এল উত্তম-সুচিত্রা, সত্যজিত-মৃণাল, হেমন্ত-সন্ধ্যা, চুনী-সুভাষ প্রমুখেরা; তাই দিয়ে কলকাতা মুখরক্ষার চেষ্টা করল।২
এখানেই শেষ নয়; সময় ধরে-ধরে কলিম খান আরো অনেক কথা বলেছেন। তবে সেসব কথা বলার আগে এই অংশটুকু নিয়ে আলোচনা করা যাক। উপরের আলোচনায় কলকাতার জায়গায় দেদারসে ঢাকা শহরের নাম বসিয়ে দেওয়া যায়। ঢাকাই বাংলা চলচ্চিত্রের ক্রমাগত অধঃপতনও দেখা যেতে পারে এই তত্ত্বের ভিতর দিয়ে। তবে কলকাতার অবস্থা আমাদের মতো শোচনীয় নয়। ঐতিহাসিকভাবে ধর্মীয় আনুকূল্য থেকে শুরু করে সংস্কৃতির দিক দিয়ে কলকাতা আমাদের চেয়ে খানিকটা মজবুতই ছিলো বলা চলে। এ কারণে, সমবলের ধাক্কায় আমাদের বিচ্যুতি খানিকটা বেশিই ঘটেছে। কলিম খানের দৃষ্টিভঙ্গি ঢাকার ওপর প্রয়োগে দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাদের আধিপত্যে গ্রামবাংলার সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে লাগলো। এখন তো আর গ্রামে-গ্রামে যাত্রাপালা, পল্লিগীতি, পুতুলনাচ চোখেই পড়ে না; পড়ার কারণও নেই। কার ঠেকা পড়েছে, না খেয়ে, না পরে, গানবাজনা করবে। তবে পুঁজিবাদ এও বোঝে, মানুষের কাছ থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদন হাতিয়ে নিতে চাইলে ‘রসের’ জোগান দিতে হবে। তাই এই ‘মহান’ দায়িত্বও সে পালন করে।
এখন ঢাকায় পল্লিগীতির শিল্পী, লালনের ‘শিষ্যের’ অভাব নেই। অর্থাৎ, গ্রামবাংলা কিংবা লোকসংস্কৃতি থেকে যা হারিয়ে গেছে, তার প্রায় সবকিছুই ঢাকায় পাওয়া যায়। দেশি সংস্কৃতি বলেন, আর দেশি কই মাছই বলেন; সবই আছে, কিন্তু হাইব্রিড; নার্সারিতে চাষ করা। এর বাইরে আছে ইমপোর্টেড প্রোডাক্ট। এই প্রক্রিয়া কিন্তু কয়েক বছর হলো শুরু হয়নি। বরং কয়েক দশক আগে শুরু হয়েছে। এখন একটা পর্যায় চলছে। কিন্তু নিজেদের সংস্কৃতির জমিন পতিত রেখে এভাবে চলার পরিণতি আরো ভয়াবহ হবে, তা অনুমান করা যায়। সাংস্কৃতিকভাবে আমরা যে দেউলিয়া হতে চলেছি, তা সমাজের ‘স্পেশালিস্ট’রা বুঝতেও পারছেন। কিন্তু কলিম খানের ভাষায় সমস্যা হলো,
যারা স্পেশালিস্ট, তাঁরা কিছুতেই একমত হতে পারছেন না। ফিউডাল, বুর্জোয়া, দক্ষিণ, বাম, আধুনিক, বিপ্লবী প্রভৃতি বহু বহু প্রকারের সংস্কৃতির স্পেশালিস্টগণের প্রত্যেকের একই দাবি : তাঁর কৃষি-কুলাচারটিই শ্রেষ্ঠ কালচার। একমাত্র তাকেই গ্রহণ করা হোক, আর বাকি সকলের মৃত্যু ঘোষণা করা হোক। যে প্রস্তাবে সমাজের সুখ-সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত হল, কোনও একটি মানবগোষ্ঠীর বিলুপ্তি, সে প্রস্তাব যতোই বৈজ্ঞানিক হোক, আজকের বিশ্ব তেমন সমস্ত প্রস্তাবকেই অবশ্য-পরিত্যাজ্য ঘোষণা করে দিয়েছে।৩
ভৌগোলিক নৈকট্য, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটসহ নানা কারণে কলকাতার সঙ্গে ঢাকার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সাদৃশ্য রয়েছে। তো কলিম খানের ভাষায়, কলকাতায় যে তালগোল পাকিয়ে গেছে ঢাকা শহরের অবস্থাও তেমনই। এ রকম একটা তালগোল অবস্থায়, যেখানে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কারখানা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে, সেখানে হিরো আলম আর কী হতে পারতো! এখন গ্রামে না আছে থিয়েটার; না আছে দেশীয় কোনো সংস্কৃতির চর্চা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে থেকে, তাই নায়ক হতে চেয়েছেন হিরো আলম। তাতে দোষের কি!
এবার দেখা যাক, হিরো হওয়ার জন্য আলম কী কী শিক্ষা অর্জন করেছেন এবং তার নিজস্বতা কী। প্রথম কথা, হিরো হওয়ার জন্য তার অভিনয় থেকে শুরু করে কোনো কিছুরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। দ্বিতীয় কথা, তার তেমন কোনো নিজস্বতাও নেই। শখ থাকার পরও সার্মথ্য না থাকায় এক আফগান শিশু যেমন পলিথিন কেটে লিওনেল মেসির জার্সি বানিয়েছিলো; নায়ক হওয়ার শখ পূরণের জন্য আলমের একাকী চেষ্টাটুকুই তার নিজস্বতা। এর বাইরে আলম যা করেছেন, তার পুরোটাই অনুকরণ। কিন্তু কার অনুকরণ? এক কথায় বলতে গেলে, আমাদেরই অনুকরণ। যারা হিরো আলমের মিউজিক ভিডিও দেখেছে, তারা বলতে পারবে। ঢাকাই বাংলা চলচ্চিত্রের গানের সঙ্গে হিরো আলমের গানের গুণগত কোনো পার্থক্য চোখে পড়া কঠিন। ওই নায়ক যেভাবে নাচে, তাকায়, অঙ্গভঙ্গি করে, হিরো আলমও সেভাবেই চেষ্টা করেন।
এ প্রসঙ্গে আরেকটু কথা বলতে চাই। হিরো আলম যে অর্থে নায়ক হওয়ার যোগ্য নয়; সেই অর্থে ঢাকাই বাংলা চলচ্চিত্রের এখন ‘সবচেয়ে যোগ্য’ নায়ক আরেফিন শুভ। তার ভক্তও অনেক। কাজও পাচ্ছেন অনেক। আমি তার একটি চলচ্চিত্র এবং কয়েকটি গানের ভিডিও দেখেছি। তাতে মনে হয়েছে, আলমের মিউজিক ভিডিওর যেসব উপকরণ দেখে মানুষ ‘পিনিক’ নেয়; প্রকৃতি প্রদত্ত চেহারার হিসাব বাদ দিলে আরেফিন শুভর গানেও পিনিকের যথেষ্ট উপকরণ আছে। ওয়ার্নিং (২০১৫) চলচ্চিত্রে জেমসের গাওয়া একটি গানের সঙ্গে আরেফিন শুভ নেচেছেন। ওই গানটা দেখার পর মনে হয়েছে, সেখানে শুভর পরিবর্তে আলমকে দিলে দর্শকের হাসাহাসির পরিমাণটা বোধহয় বাড়তো না। একই কথা নায়ক অনন্ত জলিলকে নিয়েও বলা যেতে পারে।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, হিরো আলমের মতো শুভ কিংবা অনন্ত জলিলকে নিয়েও মানুষ হাসাহাসি করে, ‘পিনিক’ নেয়। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, আমাদের পিনিক কি তাহলে নিরপেক্ষ? না। নিরপেক্ষ নয়। হিরো আলমকে নিয়ে তার সামনেই, এমনকি তার ঘাড়ে হাত রেখেই অনেকে হাসাহাসি করে; সেলফি তোলে, সাক্ষাৎকারে বলে, ‘আপনি তো শাকিব খানের ভাত মেরে দিয়েছেন।’ কিন্তু আরেফিন শুভ কিংবা অনন্ত জলিলকে নিয়ে আমাদের হাসাহাসিটা চলে আড়ালে; সেই হাসির আওয়াজও কম। মোটাদাগে এর কারণ হলো, আধুনিক এই সমাজে প্রয়োজনীয় গুণ কিংবা যোগ্যতা উল্লেখ করে যে প্রতিষ্ঠান নায়ক চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে, অনন্ত জলিল ও আরেফিন শুভ তাদের পূর্ব নির্ধারিত প্রার্থী। ফলে হিরো আলম প্রার্থী হিসেবে বাদ পড়ে যায়। আর বাদ দেওয়ার ‘যৌক্তিক’ কারণ হিসেবে আলমদের বলা হয়, বিজ্ঞপ্তিতে চেহারা নিয়ে যে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে, তা আপনার নেই। এ কারণে আপনাকে নেওয়া যাচ্ছে না। আলমের আর কী করা! নায়ক যখন হতেই হবে; তখন নিজেই ...।
৫.
অনেকেই হিরো আলমদের পরিচিতি পাওয়ার বিষয়টিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কৃতিত্ব হিসেবে দেখে। তাদের যুক্তি, মূলধারার গণমাধ্যমে যখন জায়গা হচ্ছে না; তখন ফেইসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদের তুলে আনছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ে তাকে দশ জনের মধ্যে ডেকে আনা কিংবা পরিচিত করে তোলার মধ্যে হিরো আলমের কোনো মঙ্গল হয়েছে কি? কারণ, তাকে ভরা মজলিসে ডেকে আনা হয়েছে তিরস্কারের জন্য, পুরস্কৃত করার জন্য নয়। উপহাসের পাত্র বানানো, কয়েকটি ফানি ইন্টারভিউ, তার গানকে হাসাহাসির খোরাক বানানো ছাড়া, হিরো আলমকে এই পরিচিতি আর কী দিয়েছে? এই পরিচিতির মধ্য দিয়ে হিরো আলমের যে ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে, তা মোটেও তার স্বপ্নের প্রতি সম্মান প্রদর্শন নয়। বরং বলা চলে, তার স্বপ্নটাকে অপরাধ হিসেবে তুলে ধরা। সে অপরাধ প্রজা হয়ে রাজার মেয়ের সঙ্গে প্রেমের অপরাধ; সে অপরাধ ‘কুৎসিত’ হয়ে ‘সুদর্শন’ (নায়ক) সাজার অপরাধ।
অনেকেই বলতে পারে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ‘কল্যাণেই’ তো হিরো আলম একটি টিভি বিজ্ঞাপনে কাজের সুযোগ পেয়েছেন; ‘বাংলালিংক হ্যালো স্টার’ সার্ভিসের অতিথি হতে পেরেছেন। কথা হয়তো ঠিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম না থাকলে এসব হয়তো ঘটতো না। কিন্তু যা ঘটেছে, তা নিয়েও তো আলাপ করতে হবে। যে বিজ্ঞাপনে তিনি কাজ করেছেন, সেটা কোমল পানীয়র। সেখানে তিনি অভিনেতা হাসান মাসুদের সঙ্গে কাজ করেছেন। দু’জনকেই দেখা গেছে কামার চরিত্রে। এবং এটা পরিষ্কার যে, ওই বিজ্ঞাপনে এদের দুজনকে নেওয়া হয়েছে কেবলই তাদের ‘ব্যতিক্রমী’ চেহারার কারণেই। আর বাংলালিংক তাকে অতিথি করায় অনেকে তো বাংলালিংকের সিম ফেলে দেওয়ারই হুমকি দিয়েছে। ফেইসবুকে
মো. সিদ্দিক নামে এক ব্যবহারকারী কমেন্ট লিখেছেন, ‘হা হা বাংলালিংককে ধন্যবাদ। যা একটা বায়োমেট্রিক করা সিম ছিল, সেটাও ফেলে দিবো। এসব আজাইরা কাজ করে টাইম নষ্ট করবো না।’ অনেকটা একই রকম কমেন্ট করেন মেহেদী হাসান রাতুল। তিনি বলেন, ‘বুঝতে পারছি, আমার এই বাংলালিংক সিমটা অফ করতে হবে। অনেকদিন ধরে নেটওয়ার্ক দিয়ে অত্যাচার করছিল এবার আলম্মার টর্চার’।৪
এই দুটি কমেন্টের মাধ্যমে আরেকটি বিষয়ের স্পষ্ট উপস্থিতি পাওয়া যায়। সেটা হলো, অস্বীকারের প্রবণতা। অস্বীকার কেনো? অস্বীকারের অন্যতম একটি কারণ অপরায়ণ। অর্থাৎ, হিরো আলমকে নিয়ে আমরা পিনিক নিচ্ছি ঠিকই; কিন্তু তিনি আর আমরা এক জিনিস না। আমরা দেখতে তার চেয়ে সুন্দর। আমাদের নায়ক (শাকিব, শুভ, অনন্ত) তার চেয়ে সুদর্শন।
বিচ্ছিন্নতার এই যুগে মানুষের বিত্তও নানা ভাগে বিভাজিত হয়ে পড়েছে। এখন কেবল নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের সমাজ নয় এটি। আর এই প্রকারভেদ হিসাব করার মানদণ্ড কেবল টাকা দিয়ে করা যাচ্ছে না। মানুষ সাংস্কৃতিক রুচি দিয়েও নিজেকে পৃথক করতে চায়, পৃথক করে। কেবল ভালোলাগা, না-লাগার জন্য নয়, অনেকেই মমতাজের গান শোনে না কেবল এ কারণে যে, তার গান রিকশাওয়ালারা শোনে। এ অবস্থায় একটা শ্রেণি নিজেদের শিল্পী হিসেবে তাহসানকে পরিচয় করিয়ে দেয়। কোনো কারণে যদি রিকশাওয়ালারা তাহসানের গানের মধ্যে রস খুঁজে পায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই, তাহসান ভক্তদের একটা বড়ো অংশ তাকে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করবে। সমাজে যে প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে সিগারেট ও মদ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপেক্ষা করে গাজার চেয়ে ‘কম খারাপ’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে, সেই একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির শ্রেণিকরণ ঘটে। এভাবেই হিরো আলম হয় নায়কের অপর; নায়কের বিপরীত।
গত কোরবানির ঈদের আগে (২০১৬) ‘এটিএন নিউজ’-এ একটি টক-শোতে সংযুক্ত হয়েছিলেন হিরো আলম। সেখানে তিনি কথা বলেছেন অনন্ত জলিল ও তার স্ত্রী কাম নায়িকা বর্ষার সঙ্গে। এই টক-শো’র একটা অংশ এখানে তুলে ধরছি এ কারণে যে, এই লেখার অনেক বক্তব্য এর মাধ্যমে স্পষ্ট হবে,
মুন্নি সাহা : ...। অনন্ত জলিল বলতে তিনি (হিরো আলম) পাগল। আমরা এ রকম একজন ফ্যানকে দিয়ে আজকের ইন্টারভিউটি করাতে চাচ্ছি। হিরো আলম আপনি শুনতে পাচ্ছেন, কেমন আছেন আপনি?
হিরো আলম : আপনি ভালো?
মুন্নি সাহা : জি। এখন আমি যেটা বলছিলাম, অনন্ত ভাই আর বর্ষা আছেন; উনাদেরকে আপনার যা জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, করতে পারেন। আপনি বলছিলেন, আপনি তার (অনন্ত জলিলের) মহা মহা মহা ফ্যান। এখন এ রকম একজন নায়ক এবং নায়িকাকে আপনি ইন্টারভিউ করবেন। আমি চুপ করে থাকলাম।
হিরো আলম : আস-সালামু-আলাইকুম।
বর্ষা : ওয়ালাইকুম আস-সালাম, ঈদ মোবারক।
অনন্ত জলিল : ওয়ালাইকুম আসসালাম।
হিরো আলম : আমি তো আপনার বিশাল বড়ো ফ্যান ভাই।
অনন্ত জলিল : শুনে অনেক ভালো লাগলো। আপনিও তো বাংলাদেশের অনেক জনপ্রিয় একজন।
হিরো আলম : না ভাই আপনেগের তুলনায় আমি কিছু লয়। আমি কেবল বাচ্চা, আপনেগের ছোটো। কেবল শিখিচ্চি। আপনেগের বিশেষ ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশে প্রথম যে ডিজিটাল সিনেমাটা দেখতে পাচ্চি, সেটা শুধুমাত্র কিন্তু অনন্ত জলিলের কারণে। এর আগে কিন্তু আমরা কুনুদিন এতো পরিষ্কার ছবি, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কেউ আনতে পারেনি। এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই, বাংলাদেশে প্রথম যে ডিজিটাল সিনেমাগুলো আমরা উপভোগ করছি, তার একমাত্র অবদান আপনার। আপনিই প্রথম খোঁজ দ্য সার্চ ছবিটা লিয়ে আসেন। তারপর থেকে একের পর এক ডিজিটাল হওয়া শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আপনি মাঝখানে সিনেমা থেকে সরে গেলেন কেনো?
অনন্ত জলিল : ওকে; প্রথমে আপনাকেও বলি, আপনি নিজে ছয়শো গান করেছেন। এটা দিয়ে কিন্তু আপনার গিনিস বুকে নাম লেখানোর কথা। অনেক বড়ো একটা কাজ করেছেন আপনি (মৃদু হাসি)। আর আসলে আমরা সরে যাইনি। প্রথমেই আমরা বলেছি, আমাদের প্রথম বাচ্চা হলো। এখন ২২ মাস। ইনশাল্লাহ, আমরা আর দুই মাস পর আবার শুরু করবো।
হিরো আলম : আমরা বর্তমানে যে সিনেমাগুলো দেখতে পারি, সব একধরনের। মানে একই ধরনের গল্প, একই ধরনের অ্যাকশন। আপনার সিনেমাগুলো আমরা দেখি, কারণ ব্যতিক্রম রকমের গান, ব্যতিক্রম রকমের অ্যাকশন। এর মতো দ্বিতীয় অনন্ত জলিল কিন্তু আর হবে না।
বর্ষা : ভাই, পলিটিকস করেন নাকি ভাই? ভাষণ-টাষণ দেওয়ার অভ্যাস আছে নাকি?
হিরো আলম : না আপু। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, আমি তার বড়ো একটা ফ্যান। তার পতিটা (প্রতিটা) জিনিস আমি ফলো করি। আর একটা জিনিস জেনে আমার খুব ভালো লাগিচ্চে ...।
বর্ষা : আপনি কি অনন্ত জলিলকে নকল করে-করে গান করেছেন নাকি? কোনোটা করেছেন? অনন্ত জলিলের কোনো গানের নকল করেছেন?
হিরো আলম : একটা গান করেছি। ঢাকার পোলা যে একটা গান করছে; ওইটা ভাইঙ্গা আমি বগুড়ার পোলা হিরো আলম নাম—এই একটা গান আমি করেছি।
বর্ষা : ও ...। তার আগে বলেন, গরু কিনছেন কয়টা?
হিরো আলম : দুইটা।
বর্ষা : ভাই, হিরো তো ঠিক আছে। কিন্তু নামের আগে কেনো? আপনি দিয়েছেন, নাকি ...?
হিরো আলম : চিহারা না থাকলেও মানুষ হিরো হইতে পারে—বাংলাদেশে আমি একমাত্র প্রমাণ। চিহারা থাকলেই (কেবল) মানুষ হিরো হতে পারে, এটা একটা ভুল ধারণা। মানুষের ইচ্ছাশক্তিটাই ...
বর্ষা : ভাই, একটা কথা তো শুনবেন (হাসি), জানেন আপনার কয়েকটা গান আমি দেখেছি ইউটিউবে; ভালোই লাগে। করেন। সমস্যা নাই।
অনন্ত জলিল : ওকে; আমাদের পরের ছবিতে আপনাকে নিয়ে কাজ করবো।
হিরো আলম : ধন্যবাদ। কিন্তু এটা করব্যার পারি, আর না পারি, সেটা বড়ো কথা লয়; ফেসবুকে আপনার সঙ্গে যে দর্শকরা আমার ছবি লাগায়, তাতেই আমার জীবন ধন্য। ... আমি কোনো নায়ক হওয়ার জন্য মিডিয়াতে আসিনি। আমি একটা অনাথ আশ্রম করতে চাই। তাতে আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন। অনাথদের কী দুঃখ-কষ্ট সেটা আমি দেখছি।
বর্ষা : মানুষ যে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে, জগতে কতো মানুষ, কয়জন সুপার স্টার? ... এখন হিরো আলম যে লোকটা, তার কিছু ভিডিও আমি দেখেছি। আসলে কী, প্রত্যেকটা মানুষের একটা স্বাধীনতা থাকা উচিত। বেচারা তার নিজের টাকা দিয়ে নিজে মিউজিক ভিডিও করছে, তাতে আমাদের কী সমস্যা। এটা তার স্বাধীনতা। উনি কি আমাদেরটা খাচ্ছে, না পরছে! বরং উনি যে আমাদের একটু হাসাচ্ছে, এতেই তো আমরা হ্যাপি, তাই না? মানুষকে হাসানো কিন্তু আপা (মুন্নি সাহা) খুব কষ্টের কাজ।৫
৬.
প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক আছে। সে বিতর্ক নিয়ে আলাপ তোলা উদ্দেশ্য নয়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত সংজ্ঞার আলোকে বলতে চাই, একজন প্রতিবন্ধী শিশুর প্রতিবন্ধী হওয়ার দায় কখনোই ওই শিশুর ওপর বর্তায় না। বিজ্ঞান বলছে, একটি শিশু নানা কারণে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মাতে পারে। এসব কারণের মধ্যে কেমিক্যালযুক্ত খাবার থেকে শুরু করে জিনগত বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। কিন্তু হাজারো কারণের তালিকা করলেও খোদ শিশুটিকে কোনোভাবেই কারণ হিসেবে উল্লেখ করার জো নেই। বরং আধুনিক জীবনব্যবস্থা কিংবা সমাজকে দায় দেওয়ার অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। কিন্তু সমাজ প্রতিবন্ধী শিশু জন্মানোর দায় অস্বীকার করে। এমনকি ওই শিশুটিকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনেও নেয় না। কি আশ্চর্য, যে সন্তান আমরা উৎপাদন করছি, সেই সন্তানকেই আমরা মেনে নিই না। তার ‘অস্বাভাবিক’ আচরণ দেখে আমরা হাসাহাসি করি। তাকে খেলায় নেওয়া হয় না। এ অবস্থায় যখন সে ঘরের মধ্যে একা-একা বসে আমাদেরই ‘স্বাভাবিক’ কোনো শিশুর মতো করে খেলার চেষ্টা করছে, তখন বাইরে থেকে জানালা দিয়ে তা দেখে কেউ হাসাহাসি করছে।
পরে সেই হাসাহাসি আরো কয়েকজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে শিশুটিকে এনে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়ির উঠোনে। সেখানেও সে তার মতো করে খেলছে, অন্যদিকে মানুষের হাসাহাসি থামছেই না। এ অবস্থায় ঘর ছেড়ে ওই শিশুর বাইরে আসাকে কী বলবেন? এ কথা কি বলতে পারবেন, তার খেলাধুলা করার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে? হিরো আলমকে লেখার শুরুতে ‘প্রতিবন্ধী’ নায়ক বলেছিলাম আমি এই অর্থেই। আমরা তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। অনেক মানুষ চিনলেই সেলিব্রেটিএই সংজ্ঞায় সে হয়তো সেলিব্রেটি। কিন্তু হিরো আলম সেলিব্রেটি হতে চায়নি; সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিলো।
লেখক : আসাদ লাবলু, তিনি দৈনিক কালের কণ্ঠতে সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।
asadmcru@gmail.com
তথ্যসূত্র
১. http://www.kalerkantho.com/home/printnews/375066/2016-06-27; retrieved on 15.11.2016
২. খান, কলিম (১৪০৬ : ২১১); ‘সাংস্কৃতিক মহাবিস্ফোরণের অশনিসংকেত’; দিশা থেকে বিদিশায় : নতুন সহস্রাব্দের প্রবেশ বার্তা; হাওয়া উনপঞ্চাশ প্রকাশনী, কলকাতা।
৩. প্রাগুক্ত, খান (১৪০৬ : ২১১)।
৪. http://www.ittefaq.com.bd/science-&-tech/2016/09/19/84917.html; retrieved on 15.11.2016
5. https://www.youtube.com/watch?v=cDITIaRyyPE; retrieved on 15.11.2016
মতামত
এই লেখায় মতামত দিতে লগ-ইন অথবা নিবন্ধন করুন ।