ম্যাজিক আলাপন » সিনেমা কিংবা বিজ্ঞাপন শুধু উপভোগ নয়, গবেষণারও বিষয়
সিনেমা কিংবা বিজ্ঞাপন শুধু উপভোগ নয়, গবেষণারও বিষয়
অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক। পদার্থবিজ্ঞানে দেশের প্রথম প্রফেসর ইমেরিটাস। গবেষণা-প্রাণ এই মানুষটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে দেশের শিক্ষা-গবেষণা উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। গবেষণার বাইরে তার সম্পর্ক বৃক্ষ, ফুল, পাখি আর বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে। অবসরে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে খোঁজ রাখেন এগুলোর। অধ্যাপক বসাক তার ছোটোবেলা, শিক্ষাজীবন, চলচ্চিত্র দেখা নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক কথা বলেছেন ম্যাজিক লণ্ঠন-এর জন্য। পাঠকদের কাছে তার সেই স্মৃতি অনুলিখন করে তুলে ধরা হলো।
সিনেমা আমার তেমন দেখা হয়নি। অবশ্য দেখার তেমন ইচ্ছাও করতো না। তার পরও তা নিয়ে কিছু বলতে গেলে একটু ইতিহাস বলে নিতে হবে। অত্যন্ত গরিব একটি পরিবারে আমার জন্ম। গরিব মানে কি! পাকিস্তান হওয়ার পর আমরা যেনো আরো গরিব হয়ে গেলাম। আমাদের বাড়ি পাবনায়; বাবা চাকরি করতেন ভারতের মালদহে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগে থেকেই। দেশভাগের পর আমরা ভাবলাম, যেহেতু পাকিস্তান হয়ে গেছে সেই হেতু বাড়ি বিক্রি করে আমরা ভারতে চলে যাবো। তখন আমি সেভেন কি এইটে পড়ি। সবকিছুই রেডি; কিন্তু হঠাৎই আমার মায়ের কী যেনো হলো! তিনি আর কোনোভাবেই দেশ ছেড়ে যাবেন না। সেটা গেলো আমার জীবনের একটি দিক।
এরপর ১৯৬৫ থেকে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আমাকে বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি। পাকিস্তান সরকার সেসময় আমার পাসপোর্ট পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করে রেখে দিয়েছিলো। ১৯৬৫-তে তো বিদেশে যাওয়ার জন্য বিমানের টিকিট পর্যন্ত করা হয়েছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যেতে পারলাম না। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আরম্ভ হলে আমার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। পাকিস্তান আমলে আমাকে আর পাসপোর্টই দেওয়া হয়নি। আমি সেসময়টায় দেশেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্ররা চলে গেলো, আমি বসে থাকলাম। সেই পাসপোর্ট আমি ফেরত পেলাম দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। দেশ স্বাধীন না হলে তো আমি বিদেশেই যেতে পারতাম না।
আমি যুক্তরাজ্যে পড়ার পর আমাকে সেখানে চাকরি দিতে চাইলো। একটা ফরম দিয়ে বললো, এটা পূরণ করে দাও, তোমাকে আর কিছুই করতে হবে না। অবশ্য তোমাকে কেবলই একটা সাক্ষাৎকার দিতে হবে এর জন্য। জীবনে আমি কখনো অনাহূতভাবে দরখাস্ত করে চাকরি নিইনি। এটা আমার জীবনে ঘটেছে, যেভাবেই হোক। কিন্তু এক বছর পরে বললাম, আমি থাকবো না। তাদের একটাই কথা, ‘তোমাদের দেশের মানুষ এখানে থাকতে চায়, অথচ তুমি! হোয়াট ইজ দ্য প্রবলেম উইথ ইউ? ডোন্ট ইউ লাইক আওয়ার কান্ট্রি?’ আমি বললাম, ‘না। আই লাইক ইট। বাট আই হ্যাভ অ্যা পারসোনাল প্রবলেম।’
তারপর আমি দেশে চলে আসলাম। চলে আসার একটা প্রধান কারণ বলতে পারি। আমার মা দেশত্যাগ করেননি; ফলে বাবাকে চাকরি ছেড়ে চলে আসতে হলো। আমরা তখন ভীষণ গরিব হয়ে গেলাম। পাকিস্তানে তখন আর মাইনোরিটি লোকদের ওই বয়সে চাকরির ব্যবস্থা হলো না। ফলে বাবা সাধারণ একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি শুরু করলেন। আমার মা কিন্তু ভীষণ ধনী পরিবারের মেয়ে ছিলেন। অথচ আমাদের বাড়িতে চাকর-বাকর ছিলো না। আমার মা সবসময় বলতেন, টিউশনি করতে পারবে, তবে পয়সা নিয়ে নয়।
আমাদের পরিবারে পয়সার অভাব ছিলো; তাই রাত্রিতে তিনি বসে বসে চরকায় সুতো কাটতেন। সকালবেলায় আমার কাজ ছিলো স্কুলে যাওয়ার আগে গেঞ্জির ফ্যাক্টরি থেকে সুতো আর লাটাই আনা এবং সেগুলো আবার দিয়ে আসা। প্রতিদিন সোয়া মাইল হেঁটে ওগুলো নিয়ে যেতাম, আবার নিয়ে আসতাম। তার পরও মা কখনো আমাকে টাকা নিয়ে টিউশনি করতে দেননি। আমি বহু লোককে পড়িয়েছি, কিন্তু কখনো পয়সা নেইনি।
যাক সেসব কথা। আমি ভাবলাম ইংল্যান্ডে থাকলে ভালো রিসার্চ করতে পারবো, ভালো খেতে পারবো, পয়সা কামাই করতে পারবো। দেখলাম, আমার মতো বহু লোক সেখানে আছে। কিন্তু সেটা তো আমার দেশ নয়, বিদেশ! আমার দেশে আমি যা করবো, তা দেশেই থাকবে। আমার মা কখনো দেশত্যাগ করেননি। আমি বিদেশে পড়তে এসেছি, এটাই বড়ো কথা। আরেকটি কথা হলো, আমার দেশের নাম নিয়েই তো আমি এখানে এসেছি; সরকার আমাকে পাঠিয়েছে। তাই আমি চলে আসলাম। আমি ফিরে আসার পর, আমার শিক্ষকরা তো সবাই অবাক—অরুণ, তুমি এলে!
এবার সিনেমা প্রসঙ্গে আসি। আমি প্রথম সিনেমা দেখি ১৯৬০ বা ৬১ খ্রিস্টাব্দের দিকে। একদিন আমার মা বললেন, যাও বাবা, তুমি একটু সিনেমা দেখে আসো। তখন তো আর টেলিভিশন ছিলো না। আমি তখন অনার্স পড়ি রাজশাহীতে। এখান থেকে ছুটিতে পাবনা গেলে বড়ো মানুষের সঙ্গে মা আমাকে সিনেমা দেখতে পাঠিয়ে দিলেন। এখন আর অতো বিস্তারিত মনে নেই। আমি সিনেমা দেখে এলাম। ওটা মনে হয় সাগরিকা ছিলো। ওই প্রথম। আরেকটা ওই যে বাকবাকুম করে ... কী যেনো, ওটাও সুচিত্রার। এই দুটো সিনেমাই দেখা হয়েছে জীবনে। ওটা একটা রিক্রিয়েশান। কী অদম্য ইচ্ছা! দেখার পর মনে হতো, তাই তো, ওরা এতো ভালো কথা বলে; কী সুন্দরভাবে! আমরা তো পারি না। আসলে সিনেমার জন্য রিসার্চ দরকার। একজন কাহিনি, সংলাপ লিখলো; অন্যরা অভিনয় করলো—সবই রিসার্চ। অভিনেতা, প্রেজেন্টর; সবার চেষ্টায় প্রেজেন্ট অব অডিয়েন্স সেটাকে কতো লাইভলি করা যায়। এখন দেখছি কোথাও কেউ সুচিত্রার মতো নতুন করে অভিনয় করছে। কিন্তু সেটা আসলে হচ্ছে না। কারণ এখানে সেই আবেদন নেই। বলতে পারো, পাঠকের মৃত্যু হয়েছে, তা-ও হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে সেই আবেদন নাই। অ্যান্ড দ্যাট ইজ দ্য ম্যাটার অব রিসার্চ। আমি সেটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। যদিও আমি এখন সেরকম কিছুই দেখি না।
সিনেমা নিয়ে আরেকটা মজার গল্প আছে। আমার জানা এক ছোটো ছেলে; অবশ্য সে ট্যালেন্টেড। সিনেমা দেখে এসে ও তার এক আত্মীয়ের কাছে সেটা নিয়ে গল্প করেছে। সেই আত্মীয় আমার শিক্ষক, পরে তিনি ছাত্র হয়ে ক্লাসও করতেন আমার—অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সের একসময়ের সভাপতি, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। নামকরা লোক। তো উনি একদিন গল্প করছেন, বুঝলে অরুণ, আমাদের বাড়ির পাশে একটি আড়াই বছরের ছেলে আছে; আমাদেরকে ভাই-ভাবি বলে ডাকে। একদিন এসে ছেলেটি তোমার ভাবির কাছে সিনেমার গল্প বলছে—ছেলেটা কিন্তু ঠিক মতো এখনো কথাই বলতে পারে না—সিনেমায় কীভাবে অ্যাক্টিং করে সেগুলো বলছে। তোমার ভাবি আবার আমাকে সেটা নকল করে বলছে—‘বুঝলেন না ভাবি? এমন অ্যাক্টিং ... আহ!’ ছেলেটা কিন্তু ঠিক বুঝিয়ে বলতেও পারে না। তার পরও সে বলছে—‘এমন অ্যাক্টিং। আহ! অ্যাক্টিং ও ঘটনা একাকার!’ কী ঘটনারে? ‘এই রকম ঘটনা!’ এখন ওই ছেলের মতো সবাই যদি সবকিছু মনোযোগ দিয়ে দেখতো—সিনেমা কিংবা বিজ্ঞাপন শুধু উপভোগ নয়, গবেষণারও বিষয়। এগুলো না হলে কি আর এসব (সিনেমা) থাকবে? বিজ্ঞাপন কার্যকর হবে?
ছোটোবেলার ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। আমি কিন্তু খুব দুষ্টু ছিলাম। দুষ্টু বলতে একটু অস্থির। তাই বলে একেবারে পাকালোক, সেরকমও ছিলাম না। তো যখনই আমার ঘুম আসতো, ঘুমিয়ে যেতাম। পড়ার মন হলে পড়তাম, না হলে ঘুমিয়ে যেতাম। আমার বাড়ির পাশে একটা ছেলে ছিলো, সেও হিন্দু। সে খুবই পড়তো। তো আমার মা ওর পড়া শুনে আমাকে ভীষণ গালাগালি করতো, ‘ও এতো পড়ে, তুই পড়িস না। তুই কি পাশ করতে পারবি?’ কিন্তু পরীক্ষায় দেখা গেলো আমি পাশ করেছি, ও ফেল। আমি তো অবাক! ও এতো পড়েও ফেল করলো! তো একদিন আমি ভাবলাম, দেখি তো ও কী পড়ে। গিয়ে দেখি ও পড়ছে, ‘ধরি, এ বি সি একটি ট্রাঙ্গেল; ধরি, এ ... বি ... সি ট্রাঙ ... গে ... ল।’ এভাবে পড়ছে আর ঘুমাচ্ছে। আমি বললাম, এই বেটা তোর জন্য আমি এতো গাল খাইছি, আর তুই এইভাবে পড়ছিস—‘ধরি, এ বি সি ট্রাঙ্গেল। এটা বারবার পড়ার কী আছে? এ তো একটি ট্রাঙ্গেল-ই তাই না? এটার কী মুখস্ত করিস? আর ঘুম আসলে ঘুমা, ঘুম চলে গেলে আবার পড়তে বসবি। তোর জন্য গাল খেয়ে, মনে মনে আমি তোকে কতো গাল দিছি, জানিস?’ এসব আমি ওকে সেদিন রাতে বলে চলে আসছি।
১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে টিচার্স ট্রেনিং সেন্টার থেকে একটা নেমন্তন্ন আসলো—ফাংশন হবে, আপনি আসুন। আমি সেখানে গেলাম। তো সেখানে ওই প্রতিবেশী ছেলেটিও আসলো। শিক্ষকরা গেছেন সেখানে। তো ও সেখানে এসে আমাকে বললো, এ তুই কে, অরুণ না? কেমন আছিস? এই বলে জড়িয়ে ধরলো। তখন আমি বললাম, হ্যাঁ, তুমি কে? তখন ও বললো, ‘আমি তো ...। তোকে দেখেই আমি বুঝেছি। তুই তো আমার কাছে আইডিয়াল। তুই সেদিন আমাকে গালাগালি না দিলে, আমি এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না।’ তখন আমি ওকে বললাম, আমি তো শুধু তোকে গালাগালি করেছি, এইটুকুই যা। ও বললো, ‘ওইটার জন্যেই তো আমার এই পর্যন্ত ছুটে আসা। যেদিন থেকে তুই বললি, সেদিন থেকেই তোর কথা মতো ঘুম আসলেই ঘুমিয়ে যেতাম; আর বুঝে বুঝে পড়তাম। পরে পাশ করেছি। কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ। তারপর সরকারি কলেজে চান্স পেয়ে গেছি। তারপর ওখান থেকে ট্রেনিংয়ের জন্যই এখানে আসা।’ আমি ওকে তখন খুব ভালো, ব্রাভো—এসব বললাম।
এখন এ রকমই পড়াশোনা হচ্ছে। কোনো কথা নেই, শুধু মুখস্ত করো এবং সেটা স্কুল থেকেই শেখানো হয়। ‘রহিম মানে একটি ছেলে, রহিম মানে একটি ছেলে, রহিম মানে একটি ছেলে ...।’ ‘পৃথিবী কমলা লে ..., পৃথিবী কমলা লে বু-র-র-র-র-র-র মতো গোল।’ আরে বেটা এগুলো কী? পৃথিবী কমলা লেবুর মতো গোল—এটা মুখস্ত করার কী আছে? আরেকটি উদাহরণ দিই—‘সাদা মানে শুভ্র, সাদা মানে শুভ্র।’ আরে শুভ্র মানেই না সাদা পড়বি। সাদা আগে না শুভ্র আগে? এই রকম পড়াশোনা এখন হচ্ছে। আজকের ইয়ং অ্যানার্জি সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনার পদ্ধতি, পরীক্ষা পদ্ধতি এসব। আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে দুর্বল করছে।
‘ভারত বিচিত্রা’র (মার্চ ২০১৬) একটি লেখায় দেখলাম, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মির্জা গালিব সিনেমায় সুরাইয়ার অভিনয় দেখে ও তার নিজ কণ্ঠে গান শুনে বলেছিলেন, ‘ইউ হ্যাভ পুট লাইফ ইন দ্য সৌল অব মির্জা গালিব।’ সিনেমাটিতে মির্জা গালিবের গান গেয়ে সুরাইয়া নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, পরে প্রধানমন্ত্রী নেহরু তা দেখেই এই কমেন্ট করেছিলেন। তাহলে বোঝো, অভিনয়টা কতো প্রাণবন্ত ছিলো! দ্যাট ইজ দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ; সে রকমভাবেই উপভোগ করতে হবে। এটা তো রিসার্চের বিষয়; অনুধাবনের বিষয়। শুধু তো মুখস্ত নয়, তা-ই না?
মতামত
এই লেখায় মতামত দিতে লগ-ইন অথবা নিবন্ধন করুন ।