চলচ্চিত্র-বীক্ষণ » ওসামা : স্বপ্নবান বারমাক-এর স্বপ্নহীন এগিয়ে চলা
ওসামা : স্বপ্নবান বারমাক-এর স্বপ্নহীন এগিয়ে চলা
পাথরের হৃদয়কে যে ভাঙছে সে কে?
প্রতি ঘরে মেলে দিচ্ছে যে বেদনা সে কে?
ক্ষুধার্তের হাহারব—তা কি যথেষ্ট ছিলো না?
বঞ্চিতের দুঃখ—তা কি যথেষ্ট ছিলো না?
...
ইতিহাসের চেহারা থেকে, মানবতার কান্না কী
ধুয়ে দিতে পারবে এ সকল অপমানের কলঙ্ক?১
দৃশ্যত অনেক কিছু এগিয়ে গেলেও পুরুষ প্রাধান্যশীল সমাজে নারীরা এখনো পিছিয়ে। নামেমাত্র সম অধিকারের ফাঁকা বুলিতে নারীরা এখনো নিগৃহীত বারে বার। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে নারীদেরকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে স্বয়ং রাষ্ট্রও। আবার কখনো নারীর ঘুরে দাঁড়ানোর পথকে অবরুদ্ধ করে ধর্মের হর্তাকর্তারাও। সব দিক বিবেচনায় নারী হয়ে ওঠে খেলার সেরা ‘গুটি’। অথচ নারীর এই অবরুদ্ধকরণের দায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেবল ইসলামি মৌলবাদীদের ওপরই চাপানো হয়। যা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি চর্চিত হচ্ছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে।
আফগানিস্তানে নারীদের পিছিয়ে রাখার ক্ষেত্রে কেবল তালেবানদের দায় দিয়ে প্রচলিত একটা ধারণা আছে ঠিকই; তবে তালেবান আসার আগে থেকেই কিন্তু দেশটিতে নানা কারণে প্রায় ৯৫ শতাংশ নারীদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হতো। মূলত বাকি পাঁচ শতাংশ বঞ্চিত হয় তালেবান আসার পর। তালেবান আসার আগে আফগানিস্তানে প্রতি ২০ জন নারীর মাত্র একজন লিখতে-পড়তে পারতো।২ সেদিক থেকে মৌলবাদীদের নিয়ে সমাজে প্রচলিত এই ধারণাগুলো কখনো কখনো মুদ্রার এক পিঠের উদ্ভট গল্পের মতো। যেখানে আড়ালের গল্পটা আড়ালেই থেকে যায়। যার ফলে এ ধরনের ঘটনায় সব দায় চাপে কেবল তালেবানদের মতো ইসলামি ‘জঙ্গি’দের ঘাড়ে। এই ধারণার পুনরাবৃত্তি থেকে তৈরি হয় এক একটি ওসামার। এই আলোচনা রাষ্ট্র আফগানিস্তান, তালেবানের উত্থান ও নির্মাতা সিদ্দিক বারমাকের ওসামার স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের গল্প নিয়েই এগিয়ে যাবে।
স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের আফগানিস্তান
আধুনিক আফগানিস্তানের জনক আহমদ শাহ দুররানি ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশটির কান্দাহার শহরকে রাজধানী করে দুররানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তার বংশের অন্যান্য উত্তরসূরিরা ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ সাম্রাজ্য চালু রাখেন। দুররানি সাম্রাজ্য পতনের পরও ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র কায়েম ছিলো। এই সময়ের মধ্যে দেশটির রাজধানী কান্দাহার থেকে কাবুলে স্থানান্তর করা হয়। আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে; প্রতিষ্ঠা হয় প্রজাতন্ত্র। তবে প্রজাতন্ত্রও বেশিদিন নির্বিঘ্নে চলতে পারেনি। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি অভ্যুত্থানে বামপন্থি দল পিপল্স ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান (পি ডি পি এ) ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় এসেই আফগানিস্তানে প্রচলিত ও ধর্মীয় আইনের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ ও মার্কসবাদী আইনের প্রচলন শুরু করে পি ডি পি এ। এই সরকার সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেতো।
পি ডি পি এ সরকার প্রধান নুর মোহাম্মদ তারাকি এবং মন্ত্রিপরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমিন চেয়েছিলেন, দেশটিতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চালু করতে। এজন্য তারা মসজিদের সংখ্যা সীমিত করা, ভূমি সংস্কার, কৃষি ঋণ মওকুফ, মহাজনী প্রথা বিলুপ্তকরণ, নারীদের জোরপূর্বক বিয়ে নিষিদ্ধ, নারীদের ভোটাধিকার, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়ে জোর দেয়। এসবের পাশাপাশি পুরুষদের দাড়ি মুণ্ডন বাধ্যতামূলক এবং নারীদের বোরকা পরা নিষিদ্ধ করে তারা। ফলে তাদের এ ধরনের ‘নিপীড়নমূলক’ আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ইসলামপন্থিরা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে।
তবে প্রথম দিকে তারাকি ও আমিনের মধ্যে বেশ সখ্য থাকলেও একপর্যায়ে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্বে হাফিজুল্লাহ আমিনের নির্দেশে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় তারাকিকে। হাফিজুল্লাহ ভেবেছিলেন, তার প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।৩ আবার এদিকে, বামপন্থি পি ডি পি এ’র ভাবধারা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় মুসলিম নেতারা এর বিরোধিতা করতে শুরু করে। তারা জিহাদ ঘোষণা করে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটিতে প্রচুর সৈন্য পাঠায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আশ্বাস দেয়, তারা আফগানিস্তানে এক ন্যায্য সরকার প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে জিহাদিদের বিতাড়িত করবে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয়, যে আমিন ভেবেছিলেন তার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন রয়েছে, অবস্থাদৃষ্টে সেই সোভিয়েত সামরিক বাহিনী-ই আমিনকে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর হত্যা করে।
এরপর একই মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটিতে ভয়াবহ আক্রমণ শুরু করে। এই আগ্রাসনে ১০ বছরে আফগানিস্তানে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ নিহত হয়; দুই কোটির মধ্যে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ হয় দেশান্তরি; ১০ লক্ষ পঙ্গুত্ব বরণ করে। এই আগ্রাসনে একদিকে ইসলামপন্থিদের ব্যাপক প্রসার ঘটে, অন্যদিকে সোভিয়েত সমর্থিত পি ডি পি এ’কে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলে। এ দুইয়ে মিলে বেশ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে একপর্যায়ে একজন মধ্যপন্থি পি ডি পি এ নেতাকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়, যাতে ইসলামপন্থিরা শান্ত থাকে। কিন্তু সোভিয়েতদের এই অধিকৃতির বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদিনরা তাদের গেরিলা হামলা অব্যাহত রাখে।৪
রাশিয়ার দখলদারিত্বের কালে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো বিভিন্নভাবে সমর্থন দেয় মুজাহিদিন নামের ইসলামপন্থি বিপ্লবীদের। এই সময় পাকিস্তানের সাতটি এবং ইরানের আটটি দল রাশিয়ার দখলদারিত্বের বিরোধিতা করে। একপর্যায়ে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হলে পাকিস্তান-ইরানের ওই ১৫টি দল প্রচুর অস্ত্র নিয়ে দেশটিতে ঢুকে পড়ে। তখন দেশে কোনো নির্দিষ্ট প্রশাসন না থাকায় দলগুলো নিজেদের ক্ষমতার জানান দিতে নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই গৃহযুদ্ধে শুধু রাজধানী কাবুলে ৬৩ হাজার মানুষ নিহত হয়। এ সময় সি আই এ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, যুক্তরাষ্ট্র) মুজাহিদিনদের ক্রমাগত আর্থিক ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতো। কিন্তু দিন দিন মুজাহিদিনদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে সি আই এ’র নির্দিষ্ট অর্থে খানিকটা টান পড়ে।
তখন তারা মুজাহিদিনদের সারাদেশে আফিম চাষে উদ্বুদ্ধ করে। মুজাহিদিনরা কর হিসেবে কৃষকদের আফিম চাষের নির্দেশ দেয়। এদিকে দেশজুড়ে হেরোইনের ল্যাবরেটরি বানিয়ে দেয় পাকিস্তানের আই এস আই (ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স)। ফলে অল্প সময়েই সারাবিশ্বের সবচেয়ে বড়ো হেরোইন উৎপাদনকারী এলাকা হয়ে ওঠে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত। আফগানিস্তানে উৎপন্ন এই আফিম মূলত সি আই এ ক্রয় করতো। আফিমের বিনিময়ে সি আই এ থেকে পাওয়া অর্থে মুজাহিদিনরা ধীরে ধীরে সামরিকভাবে আরো শক্তিশালী হতে থাকে। একসময় মুজাহিদিনেরা পি ডি পি এ সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ জোরদার করে। অবশেষে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে এ সরকারের পতন ঘটে।
ঠিক এই সময় ‘তালেবান’ (পশতু ভাষায় ছাত্রের বহুবচন তালেবান, আরবি ভাষায় দু’জন ছাত্রকেও বোঝানো হয়) নামে একটি গোষ্ঠী আফগানিস্তানের দক্ষিণে কান্দাহারে আন্দোলন শুরু করে। সেসময় অপহৃত দুই কিশোরীকে উদ্ধার করে দলটি বেশ আলোচিত হয়। এই অপহরণের সঙ্গে জড়িত এক গভর্নরকে তারা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডও দেয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে দলটির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী কাবুলসহ দেশের ৯৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে নেয় দলটি। এই জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির অবশ্য বেশকিছু কারণও ছিলো। গৃহযুদ্ধের সময় দেশব্যাপী ব্যাপক অনিরাপত্তার সৃষ্টি হয়। এই সুযোগ নেয় তালেবান; নিরস্ত্রীকরণনীতি এবং শান্তির অগ্রদূত হিসেবে তারা আর্বিভূত হয়। তালেবান অবশ্য অনেকক্ষেত্রে আফগানিস্তানের মানুষদের নিরাপত্তা দিতে সমর্থও হয়। তাদের বিধান মোতাবেক কঠোর শাস্তির ভয়ে রাস্তায় এক টুকরা রুটি পড়ে থাকলেও তা কেউ নেওয়ার সাহস করতো না।
একপর্যায়ে ক্ষমতায় এসে তালেবানরা তাদের নিজস্ব প্রথা আর শরিয়া আইন ধীরে ধীরে কায়েম করতে থাকে। তালেবানদের সমর্থন দিতে থাকে পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তালেবান শরিয়া আইনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে নারীরা। তারা নারীদের স্কুলে যাওয়া ও চাকরি নিষিদ্ধ করে। শরিয়া মোতাবেক না চললেই তাদের কঠোর শাস্তি, পরকীয়া প্রেমের শাস্তি হিসেবে জীবন্ত কবরসহ নানাধরনের বিধি চালু করে তালেবান। শুধু তাই নয়, কোনো নারী নিজের চিকিৎসা করাতে চাইলে অবশ্যই তার সঙ্গে ছেলে, স্বামী বা বাবা থাকতে হবে। এমনকি বিয়েতে কনে নয়, তার ভাই অথবা বাবা ‘কবুল’ বলবে।
ইরানের বিখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা মোহসেন মাখমালবাফ এই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—
ছবি বানানোর সময় আমি দেখেছি বুড়ো লোকেরা ১০ বছরের বালিকাকে বিয়ে দিচ্ছে এবং সেখান থেকে যে টাকাটা পাচ্ছে তা দিয়ে নিজেদের জন্য বিয়ে করে আনছে আরেকটা ১০ বছরের বালিকা। তার মানে, এই বালিকাদের এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি স্থানান্তর করতে একটা সীমিত পুঁজি এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘুরছে। এদের মধ্যে এমন মহিলা অনেক, স্বামীর সাথে যাদের বয়সের ব্যবধান ৩০ থেকে ৫০ বছর।৫
তবে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তালেবান পতনের পর দেশটিতে নারীরা স্কুলে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে, কিন্তু রক্তপাত বন্ধ হয়নি। এখনো সেখানে প্রতিদিন দখলদার আমেরিকানদের সঙ্গে `সন্ত্রাসী'দের লড়াইয়ে মানুষ মারা যায়, রক্ত ঝরে।
নির্মাতা বারমাক ও ওসামা আখ্যান
`আমার হৃদয়ে আজ ব্যথা, কারণ আমি একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা। আমি কোনো বক্তা নই, আমি লেখক নই, আমি কবিও নই। আমার ভাষা হলো ইমেজ। তাই আমি কিছু বলতে পারি শুধুমাত্র ইমেজের মাধ্যমে।'৬ কথাগুলো আফগান চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্য রচয়িতা এবং আফগান শিক্ষা আন্দোলনের সংগঠক সিদ্দিক বারমাকের। যার নির্মিত চলচ্চিত্র গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার অর্জনের পরও তিনি ছিলেন একেবারে নির্জীব। তিনি বলেছিলেন, `চলচ্চিত্রটি গোল্ডেন গ্লোব না অস্কার পেলো, এটা কোনো বিষয় না। আমি আমার চিন্তা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি।'৭ ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের পানশির শহরে জন্ম উদ্যমী মানব সিদ্দিক বারমাকের।
কীভাবে যেনো ছোটোবেলা থেকেই বারমাক চলচ্চিত্র-নির্মাণের স্বপ্নটা নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, এজন্য প্রয়োজন অ্যাকাডেমিক প্রশিক্ষণ। কঠোর প্রচেষ্টায় ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মস্কো ফিল্ম স্কুলে পড়ার জন্য বৃত্তি পান সিদ্দিক বারমাক। মনে স্বপ্ন আর বুকে তীব্র ইচ্ছা নিয়ে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে পাড়ি জমান মস্কোতে। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সেখানে চলচ্চিত্র-নির্মাণের ওপর পড়াশোনা করেন। কোর্সের অংশ হিসেবে সে বছর দ্য আউটসাইডার নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বারমাক। তিনি এই চলচ্চিত্রে আফগানিস্তানের সরকারি কর্মীদের দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরেন। পরে বারমাক এই চলচ্চিত্রটি আফগানিস্তানে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত আফগান সরকার বারমাকের চলচ্চিত্রটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এতে অবশ্য নিরাশ হননি বারমাক। পরবাসে থেকে নিজের দেশে চলচ্চিত্রটি দেখানোর আশায় থাকেন তিনি। তবে এই সময়ের মধ্যে আরো একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা বারমাককে ধীরে ধীরে আর্থিক সঙ্কটে ফেলে। একপর্যায়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণের অর্থ জোগাড়ের জন্য বারমাক পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তানে আসেন। শুধু পাকিস্তান নয়, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের পর বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে তিনি চলচ্চিত্রের জন্য অর্থ জোগাড়ের চেষ্টা করেন।
তখন সোভিয়েত-আফগানিস্তান যুদ্ধ চরমে। সোভিয়েত আগ্রাসনে ঝলসানো মাতৃভূমিতে ফেরা নিয়ে বারমাকের মনে তখন উৎকণ্ঠা; কবে তিনি দেশে ফিরবেন? দেশে ফেরা নিয়ে আক্ষেপের কথা বারমাক প্রায়ই কাছের বন্ধুদের বলতেন। তার আক্ষেপের ভাষা ছিলো এমন—`গান্ধী যদি নিজ দেশে ফিরে আসতে পারেন, হো চি মিন যদি প্যারিসের বিলাস জীবন ছেড়ে সংগ্রামের উদ্দেশ্যে নিজ দেশে যাত্রা করতে পারেন, তবে আমি কেন পারব না?’’৮ স্বপ্ন তার একসময় সত্যি হয়। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঠিকই নিজ দেশে ফিরে আসেন। তবে ততোদিনে সোভিয়েত আগ্রাসন শেষে তালেবানি শাসনের পথে মাতৃভূমি।
তালেবানরা তখন ইসলামি শরিয়ার পাশাপাশি নিজেদের চালু করা নিয়ম কায়েম করতে বিভিন্ন জায়গায় ভয়াবহ নৃশংসতা করছে। এই পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বারমাক বলেন, ‘‘তালেবান শাসনের সবচেয়ে বড়ো যে খারাপ দিক সেটা হলো, তখন মানুষ নিজের জন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না। তালেবানরা আফগান সমাজে মানবতাটাকে একেবারে ভেঙে দিয়েছিলো।’’৯ ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাবুলে অবস্থান করার সময় বারমাক আফগান ফিল্ম অর্গানাইজেশনের (এ এফ ও) প্রধান ছিলেন। কিন্তু তালেবানরা একপর্যায়ে চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই সময় বারমাকের জীবনে মর্মান্তিক এক ঘটনা ঘটে। তালেবান বাহিনী একদিন তার বাসায় হামলা চালায়। হামলায় বারমাকের সদ্য জন্ম নেওয়া পুত্র সন্তান নিহত হয়। তার চলচ্চিত্র, প্রজেক্টর মেশিন ধ্বংস এবং আট মিলিমিটারের ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়। পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বারমাক বলেন, ‘‘শুধু এগুলো নয়জাতীয় গ্যালারি, জাতীয় চলচ্চিত্র আর্কাইভস ও রেডিও-স্টুডিও আর্কাইভসগুলোও ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় মোল্লারা।’১০
তবে এতো সব সঙ্কটের মধ্যেও ভেঙে পড়েননি বারমাক। তার পরও স্বপ্নকে সঙ্গী করে তিনি মাতৃভূমিতে ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে, ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে বারমাক বিবিসি পাকিস্তান শাখায় কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি ‘‘ইরফান’’ নামের একটা সাংস্কৃতিক সংগঠনে তিনি যুক্ত হন। তখন পত্রিকায় নিয়মিতভাবে আফগানিস্তানের নানা খবর প্রকাশ হতো। এসব খবরের মধ্যে থেকে কাবুলের একটি ঘটনা বারমাককে বেশ নাড়া দেয়—তালেবান শাসনের ভয়ে একটি মেয়ে স্কুলে যায় ছেলের ছদ্মবেশে। ঘটনাটি বারমাকের মনে দাগ কাটে। এখান থেকেই ভাবনা-চিন্তা শুরু হয় চলচ্চিত্র ওসামার।
পাকিস্তান থেকে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে কাবুলে ফিরে আসেন বারমাক। ততোদিনে নারীরা শুধু স্কুল নয়, বাড়ির বাইরে কাজ করার অধিকারটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। গণমাধ্যম বলতে তখন কেবল বেতার। এই সময়ে নিয়মিত বেতার শুনতেন বারমাক। তিনি লক্ষ করেন, বেতারের একটি অনুষ্ঠানে একজন মোল্লা ধর্মীয় শিক্ষার নামে মূলত যৌন বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছেন। তার আলোচনার বেশিরভাগটাই ছিলো পুরুষাঙ্গ কীভাবে পরিষ্কার করতে হয়, সে বিষয়ে। পত্রিকায় পড়া সেই ঘটনা আর রেডিওর এই অনুষ্ঠান ওসামার স্ক্রিপ্টকে আরো সমৃদ্ধ করে। চলচ্চিত্রের নেশা আর প্রতিবাদের ভাষা এক হয়ে একসময় নির্মাণ হয় ওসামা। এটি বারমাকের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
২০০৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি ভাষার সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ওসামা ‘‘গোল্ডেন গ্লোব’’ পুরস্কার অর্জন করে। ওসামা ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে কান উৎসবেও মুক্তি পায়। সেখানেও ‘‘কান জুনিয়র অ্যাওয়ার্ড’’ ও ‘‘গোল্ডেন ক্যামেরা-স্পেশাল মেনশন’’ বিভাগের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পায় এটি। বুসান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য পুরস্কার পান এই নির্মাতা।১১ বারমাক পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ডিভার (১৯৮৪), সারকেল (১৯৮৫), বিগানা (১৯৮৭), ওপিয়াম ওয়ার (২০০৮)। তার প্রযোজিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে কোরবানি (২০০৪), আর্থ অ্যান্ড অ্যাসেজ (২০০৪), আপেল ফ্রম প্যারাডাইস (২০০৮), নেইবর (২০০৯)। ৫৪ বছর বয়সি বারমাক এখন নিজ মাতৃভূমি কাবুলেই বাস করছেন। তার ভাষায়, ‘‘কাবুলেই বাবা-মা, দুই কন্যা আর স্ত্রী নিয়েই আমার সংসার।’১২
আলো হাতে এক পথিক
আগেই বলেছি, আফগানিস্তানের শিক্ষা আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সিদ্দিক বারমাক। এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ইরানের বিখ্যাত নির্মাতা মোহসেন মাখমালবাফ। কান্দাহার নির্মাণের পর ৯/১১’’র আগে মূলত মোহসেন মাখমালবাফই প্রথম আফগান শিশুদের শিক্ষাদানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এজন্য তিনি ইরানের সীমান্তে ‘আফগান চিলড্রেনস এডুকেশন মুভমেন্ট’ (এ সি ই এম) গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য তখন ইরান সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মোহসেন।
২০০১ খ্রিস্টাব্দে তালেবান পতনের পর এই প্রতিষ্ঠানটি আফগানিস্তানে স্থানান্তর করা হয়। তখন এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে আসেন সিদ্দিক বারমাক। পরে বারমাকের উদ্যোগে আফগানিস্তানে ধীরে ধীরে নানাধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি নতুন নতুন চিন্তাভাবনায় শিশুদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। এছাড়া এখানে অভিনয় ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বারমাক বিশ্বাস করেন, ‘‘এই ছেলে-মেয়েদের মধ্য থেকে নিশ্চয় ভবিষ্যতের কোনো মহৎ চলচ্চিত্রনির্মাতা তৈরি হবে।’’ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এতো সব উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের জন্য রাষ্ট্র কোনো খরচ বহন করে না। নিরুপায় বারমাক নিজে এবং তার কিছু জাপান প্রবাসী বন্ধুর সহায়তায় এই কার্যক্রম এগিয়ে নিতে থাকেন। পরে অবশ্য এই শিক্ষা আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে ইউনেস্কো অর্থ সহযোগিতা দেয়।১৩
ওসামা : ‘‘স্বপ্ন-স্বপ্ন-স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখে না মন’
স্বপ্নহীনতা-১
নীল বোরকা পরে আফগানিস্তানের বিধবা নারীরা এক স্থানে জমায়েত হচ্ছে। হাতে প্ল্যাকার্ড-ব্যানার বহনকারী নারীদের মুখে স্লোগান—‘‘কাজ চাই, কাজ করার অধিকার চাই/ আমরা কোনো রাজনৈতিক দল নই/ আমরা ক্ষুধার্ত/ আমাদের কাজ দাও’’; এমন সময় তালেবানদের আগমন। তাদের জল কামান আর গোলাবারুদের তোপে নারীরা ছত্রভঙ্গ। চারদিকে শিশু আর বিধবাদের আহাজারি। সবাই রক্ষা পেতে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। কেউ কেউ রক্ষা পেলেও বাকিদের মুরগির মতো খাঁচাবন্দি করে নিয়ে যায় তালেবানরা।
ওসামার নারীদের বেঁচে থাকার লড়াই তালেবানদের জল কামান আর গুলির মুখে শুরুতেই শেষ হয়ে যায়। টিকে থাকার এ লড়াইয়ের লেশমাত্র পুরো ওসামায় আর কোথাও দেখা যায় না। এরপর শুধুই তালেবানদের শোষণ-নিপীড়ন। তালেবান শাসনের বিরুদ্ধে কোনো আফগানকে টু শব্দ পর্যন্ত করতে দেখা যায় না। অথচ ইতিহাস জানান দেয়, সমাজে চরম প্রতিক্রিয়াশীলতার মধ্যেও প্রগতিশীলতা, আবার এর উল্টোটাও হাজির থাকে। প্রগতিশীলরা পরিবর্তনে সমর্থন দেয়, আর প্রতিক্রিয়াশীলরা টিকে থাকতে চায়। আফগানিস্তানেও একটি পক্ষ ছিলো, যারা সোভিয়েত শাসন মেনে নিয়েছিলো, অন্য পক্ষ পরিবর্তন চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত লেজ গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। অথচ ওসামায় সেই আফগানরাই বিনা প্রতিবাদে তালেবানদের জোরজুলুম মেনে নেয়! কেউই তালেবানদের বিরুদ্ধাচরণ করে না।
এর মানে এই নয় যে, সাধারণ মানুষকে অস্ত্র নিয়ে তালেবানদের বিরুদ্ধে মাঠে নামা দেখাতে হবে। কিন্তু ওসামার সেই চা-দোকানি (যিনি ওসামাকে কাজ দেন), হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর সন্তানসহ যে কয়জন আফগানকে দেখানো হয়, তারা সবাই কেনো জানি তালেবানদের এড়িয়ে চলে। ভাবটা এমন যে, আমি তো ‘ভালো’ আছি, তাহলে আর শুধু শুধু ওদের সঙ্গে লাগতে যাবো কেনো! চলচ্চিত্রজুড়েই আফগানদের মুখ বুজে তালেবান শাসন মেনে নিতে দেখা যায়। যা দেখিয়ে বারমাক এমনটি প্রমাণ করতে চান কি না যে, আফগানদের এই অবস্থা দূর করতে বহিরাগত ‘মিত্রের’ গত্যন্তর নেই!
স্বপ্নহীনতা-২
ওসামার কেন্দ্রীয় চরিত্র কিশোরী ওসামা। বৃদ্ধ দাদি আর মাকে নিয়ে তার সংসার। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে তার বাবা মারা গেছেন। মা হাসপাতালে সেবিকা হিসেবে কাজ করতেন। তালেবানের আদেশে হাসপাতালে নারীদের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনিও বেকার। পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে না পেরে ওসামার মায়ের আক্ষেপ—‘সৃষ্টিকর্তা যেনো মেয়ে বানিয়ে কাউকে পৃথিবীতে না পাঠায়!’’ এ কথার প্রত্যুত্তরে ওসামার দাদির বক্তব্য—“‘এসব তুমি কী বলছো? নারী-পুরুষ উভয়ই সমান। আমি এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখি না। উভয়ই পরিশ্রম করতে পারে। সমানভাবে শোষণ-বঞ্চনার শিকারও হয়। শ্মশ্রƒমুণ্ডিত একটা ছেলেকে বোরকা পরিয়ে দিলেই সে ‘‘মেয়ে’’ হয়ে যাবে। আবার একটি মেয়েকে ছোটো চুল, টুপি ও প্যান্ট পরালে ‘ছেলের’ মতো মনে হবে।”
একটু পর ওসামার দাদিকে অবশ্য সেই কাজটাই করতে দেখা যায়। তিনি ওসামার চুল কেটে দিয়ে তাকে পুরুষের বেশে বাইরে কাজে পাঠান। সে ছেলে সেজেই চায়ের দোকানে চাকরি করে, মসজিদে নামাজ পড়ে। যদিও তা আফগান নারীদের চরম দুরবস্থাকেই ফুটিয়ে তোলে। তবে এর মধ্যেও এক ‘‘স্বপ্নহীন’’ স্বপ্ন নিয়ে হাজির হন বারমাক—ওসামার কাটা চুলের বেণি টবে লাগিয়ে স্বপ্ন জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেন। ওসামা তাতে নিয়মিত পানি দেয়। হয়তো বারমাক বুঝিয়ে দেন, তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের অবস্থাও ওই চুলের মতোই, যতো পরিচর্যাই করো নতুন পাতা আর গজাবে না।
স্বপ্নহীনতা-৩
ওসামার ৫৫ মিনিটে একটি আফগান বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান চলে। নারীরা নাচগানে মশগুল। এমন সময় একটি শিশু এসে খবর দেয়, তালেবান আসছে। মুহূর্তের মধ্যেই পরিস্থিতি একেবারে উল্টে যায়। নারীরা দ্রুত বোরকা পরে নেয়; বাদ্যযন্ত্রগুলো ঢুকিয়ে নেয় সেই বোরকার আড়ালে। গানের বদলে সুর তুলে কান্না শুরু হয়। তালেবানরা সেখানে পৌঁছালে বাড়ির কর্তাগোছের একজন বলেন, ‘‘আমার মা মারা গেছে।’’ তালেবান শাসনের ভয়াল পরিস্থিতি তুলে ধরতেই হয়তো বারমাকের এই আয়োজন—বিয়ে বাড়ি থেকে মরা বাড়ি। কিন্তু বারমাক যতো সহজে বিষয়টি তুলে ধরেন তাতে খানিকটা খটকাই লাগে। এটা জানা কথা, ধর্মীয় কারণে তালেবানরা আফগানিস্তানে গানবাজনা নিষিদ্ধ করেছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে, তাদের আগমনে শুধু গান বন্ধ করে বাদ্যযন্ত্রগুলো লুকিয়ে ফেললেই হতো। কিন্তু বিয়ে বাড়ি থেকে মরা বাড়িতে রূপান্তর কেনো? তালেবান কি বিয়েও নিষিদ্ধ করেছে! অন্যভাবে দেখলে, নির্মাতা হয়তো সামগ্রিক অর্থে তালেবান পূর্ব ও পরবর্তী আফগানিস্তানকে তুলে ধরতে চেয়েছেন এই দৃশ্যে। তিনি হয়তো বলতে চান, তালেবান শাসনের আগে আফগানিস্তানে আনন্দ-উৎসব চলতো, পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ ছিলো। তালেবান আসার পরেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
নির্মাতা এটা বললেও ইতিহাস কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। তালেবান আগমনের পূর্বে পি ডি পি এ সরকারের আমলেও নারী বা পুরুষ কাউকেই স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া হয়নি। আগেই বলা হয়েছে, পি ডি পি এ সরকার বোরকা পরা নিষিদ্ধ এবং দাড়িমুণ্ডন বাধ্যতামূলক করেছিলো। তার মানে তালেবানি শাসনের ঠিক উল্টো রূপটি ছিলো তখন। দৈনন্দিন জীবন যাপনসহ পুরুষদের দাড়ির দৈর্ঘ্য কতোটুকু হবে তা যেমন এখন তালেবান ঠিক করে দিচ্ছে; তখন তেমনই দাড়িমুণ্ডন বাধ্যতামূলক ছিলো। দুই পরিস্থিতিতেই আদেশের নড়বড় হলে শাস্তি। মোটকথা কেবল ক্ষমতার হাতবদল, শাসনের হাল একই। সেদিক থেকে বিচার করলেও ওসামায় কেবল মুদ্রার একটি পিঠই উপস্থাপন করেছেন বারমাক।
স্বপ্নহীনতা-৪
বিভিন্ন ‘‘অপরাধে’’ দোষীদের বিচার করতে বসে তালেবান নেতারা (এক ঘণ্টা ছয় মিনিট ৪০ সেকেন্ড)। প্রথমে গুপ্তচরবৃত্তি ও নাস্তিকতার দায়ে শ্বেতাঙ্গ সাংবাদিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় গুলি করে। মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও এই সাংবাদিককে নির্লিপ্ত দেখা যায়। মৃত্যুর বিন্দুমাত্র ভয় তার চোখে-মুখে প্রকাশ পায় না, বরং পাশের এক তালেবানের কাছ থেকে সিগারেট জ্বালানোর জন্য আগুন চেয়ে বসেন তিনি। সেদেশে ধূমপান নিষিদ্ধ হলেও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি প্রাণ ভিক্ষা না চেয়ে আগুন চাচ্ছে—বিষয়টি নিঃসন্দেহে ওই সাংবাদিকের দুঃসাহসিকতারই পরিচায়ক। অবশ্য চলচ্চিত্রের শুরুতেও ওই সাংবাদিকের সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। সেসময় ধূপ জ্বালিয়ে মঙ্গলকামনা করা এক কিশোরকে এক ডলার ভিক্ষা দেন তিনি। বোঝা যায়, এই সাংবাদিক সুদূর পশ্চিম থেকে এসেছেন। আবার ওই কিশোর যখন ওসামা ও তার মায়ের জন্য একইভাবে মঙ্গলকামনা করে, তখন ওসামার মা বারবার বলেন, ‘‘আমাদের কাছে টাকা নেই।’’ এর উত্তরে কিশোর ওই সাংবাদিককে দেখিয়ে বলে, ‘‘আপনাকে টাকা দিতে হবে না, টাকা দিবে ওই লোক।’
কিছু পরে এই সাংবাদিকই নারীদের আন্দোলন এবং সেখানে তালেবানদের হামলার চিত্র ধারণ করেন। শেষ পর্যন্ত তাকে বন্দি করে তালেবানরা। যতোটুকু বোঝা যায়, বিশ্বদরবারে আফগানিস্তানের সঙ্কটময় পরিস্থিতি তুলে ধরতেই এই ‘‘সাহসী’’ সাংবাদিকের আগমন। যিনি প্রাণের মায়া ত্যাগ করে দুর্দশাগ্রস্ত আফগানদের “‘ত্রাতা”’ হতে আসেন। সেসময় আফগানিস্তানে কর্মরত সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে শর্ত ছিলো—তারা তালেবানদের কর্মকাণ্ড প্রকাশ থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করে কাজ করেন ওই সাংবাদিক। পশ্চিমা সাংবাদিক সাহসী, মানবতার পক্ষে—এই ঘটনায় নির্মাতার এই ইঙ্গিত বুঝতে কষ্ট হয় না। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—শ্বেতাঙ্গ কেনো, আফগানে কোনো সাহসী সাংবাদিক নেই; যিনি জীবন বাজি রেখে এই চিত্র বিশ্ববাসীকে জানাতে পারতেন। বারমাক নিজেও তো বিবিসি’’তে কাজ করতেন। তিনিও কি আফগানিস্তানের এমন দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতিতে চোখ-মুখ বন্ধ করেই ছিলেন? নাকি তালেবান ‘‘মুজাহিদ’’দের পাশে যেমন একসময় যুক্তরাষ্ট্র দাঁড়িয়েছিলো, তেমনই তাদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় সেই যুক্তরাষ্ট্রকেই লাগবে!
বিচারের দ্বিতীয় আসামি হাসপাতাল থেকে ধরে আনা শ্বেতাঙ্গ নারী চিকিৎসক। মাটিতে অর্ধেক পুঁতে পাথর নিক্ষেপে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তালেবান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে থাকা ছোটো ছেলেদেরও বড়োদের সঙ্গে সমান উৎসাহে সেই নারীকে পাথর ছুড়তে দেখা যায়। এর আগেও অবশ্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুদের তালেবান করে তোলার নানা প্রক্রিয়া দেখানো হয় ওসামায়। নামাজ পড়া থেকে গোসল করা সবই সেই প্রশিক্ষণের অংশ। একটা নির্দিষ্ট বয়স পর আফগান শিশুদের তালেবানি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যেতে হয়। সেখানে তার মধ্যে একধরনের তালেবানি মূল্যবোধ, নৈতিকতার চর্চা চলতে থাকে। যা তার পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে বারমাক কেনো জানি একজন শিশুকেও দেখান না, যে এই চর্চার বাইরে কোনো আচরণ করে! সব শিশুরাই তবে কি তালেবানি শাসন মেনে নিয়েছে! আফগানদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন তাহলে কোথায়? ওসামার উপস্থিতি তো সেখানে একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গে। শিশুদের এই প্রশিক্ষণ সারাজীবন তাকে শুধু ‘‘তালেবান’’ করে রাখে। সে লালন করে হিংস্রতা। এই চর্চাই হয়তো মার্কিন বিমান হামলায় হাজার হাজার আফগান শিশু হত্যার ‘‘অনুমতি’’ দেয়।
স্বপ্নহীনতা-৫
সাংবাদিক ও হাসপাতাল থেকে ধরে আনা নারীর তালেবানি বিচারকার্য শেষ হওয়ার পর আসে ওসামার পালা। তার অপরাধ সে নারী হয়ে পুরুষের বেশ ধারণ করেছে। তার শাস্তি হয়, এক বৃদ্ধের চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে বন্দি জীবন। বৃদ্ধের বাড়িতে আসার পর ওসামাকে এক এক করে সাজাতে আসেন আগের তিন স্ত্রী। তারা একে একে ওসামাকে তাদের বন্দি হওয়ার গল্প শোনায়।
প্রথম স্ত্রী : তালেবান ধ্বংস হোক। ওরা আমাদের বাড়ি, ফসল, বাগান পুড়িয়ে দিয়েছে। তখন আমার কিছুই করার ছিলো না। আমাকে ধরে নিয়ে এসে ওরা এই বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। ওরা আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে। এখন বাঁচার মতো কোনো অবলম্বন আমার নেই।
দ্বিতীয় স্ত্রী : আমরা ছিলাম শরণার্থী। তালেবান আমার ভাইকে ধরে মেরে ফেলে আর আমাকে এই বৃদ্ধের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
তৃতীয় স্ত্রী : একদিন রাতে আমি আমার হাতে মেহেদি লাগাচ্ছিলাম। তালেবানসহ ওই বৃদ্ধ সেখানে হাজির হয়। তারপর আমাকে জোর করে বিয়ে করে। এখন আমার জীবন দুঃখ-দুর্দশায় ভরা। আমি তাকে ঘৃণা করি কিন্তু আমার কী-ইবা করার আছে? এই নিষ্ঠুর লোকটা আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে।
একপর্যায়ে বৃদ্ধ ঘরে নিয়ে গিয়ে ওসামাকে অনেকগুলো তালা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেন—‘কোনটা তোমার পছন্দ?’’ ওসামা যখন নিশ্চুপ, তখন ওই বৃদ্ধ একটি বড়ো তালা দেখিয়ে বলেন, ‘‘এটা তোমার জন্য বিশেষভাবে তৈরি।’’ বোঝা যায়, বৃদ্ধ তার বাকি তিন স্ত্রীকে আটকে রাখার জন্যও আলাদা আলাদা তালার ব্যবস্থা রেখেছেন। রূপক অর্থে ওসামার এই বন্দিত্ব হয়তো গোটা আফগানিস্তানের মানুষেরও। তালেবান দাপটে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের জীবনের বন্দিদশা এই তালা দিয়ে স্পষ্টতই প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে নির্মাতা সিদ্দিক বারমাক নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তবে দ্বিধাটা সেখানেই—তালেবানি তালাবদ্ধ মানুষ থাকলেও তালা ভাঙার একজনও নেই ওসামায়! ওসামা জুড়ে বারমাক দেখান-বোঝান, আফগানরা কেবল ‘‘বেঁচে’’ আছে, তাদের জীবন নেই। তিনি হয়তো এও বোঝাতে চান, জীবনহীন মানুষ কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। তাহলে কি এই তালার চাবি সাদা চামড়ার কোনো বিদেশি ‘‘বন্ধু’’র কাছে আছে!
স্বপ্নহীনতা-৬
ওসামাকে পুরুষ সাজাতে দাদি চুল কেটে দিচ্ছেন (১৯ মিনিট এক সেকেন্ড), ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হয় ওসামা দড়ি-লাফ খেলছে। ওসামা যখন জীবিকার তাগিদে ছেলের বেশে একটি দোকানে কাজ করে, তখনো কাজ ফেলে তাকে এই খেলা করতে দেখা যায়। এক ঘণ্টা চার মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ওসামা যখন তালেবান জেলখানায় বন্দি, তখনো কাট টু শটে বারবার ওই দড়ি-খেলা দেখানো হয়। ওসামার শেষ দৃশ্যটিতেও ওসামা দড়ি-লাফই খেলতে থাকে। চলচ্চিত্র জুড়ে বারবার এই দৃশ্য ও শেষ দৃশ্যের ব্যাখ্যা সিদ্দিক বারমাক নিজেই দিয়েছেন। তার ভাষায়, ‘‘নারীরা প্রতীকী এই জেলখানার চেয়ে বড়ো জেলখানায় বন্দি। নারী-পুরুষের পার্থক্যের অসমতায় তারা আজ বন্দি।’’১৩ কিন্তু বারমাক কেনো জানি এই দৃশ্যের বিপরীত ব্যাখ্যাটা দেন না। এই বন্দিত্ব থেকে ওসামাদের মুক্তি কবে?
এটা তো স্বাভাবিক যে, রাষ্ট্র-সমাজে শোষণের মাত্রা চরমে পৌঁছালে, তার মধ্যেই এর বিপর্যয়ের বীজ জন্ম নেয়। সমাজে তৈরি হয় নতুন কাঠামো। ওসামাদের তো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তার পরও নির্মাতা ওসামাকে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস দেন না। উল্টো বারবার দড়ি-খেলা দিয়ে হয়তো বুঝিয়ে দিতে চান, যতোই লম্ফঝম্প করো, ওই দড়ির বৃত্তের বাইরে বের হওয়ার সাধ্য তোমার নেই। এই দড়ি তালেবানদের, যে দড়িতে কেবল ওসামা নয়, আটকা পড়েছে পুরো আফগানিস্তান।
শেষ, তবে শেষ নয় ...
ওসামার শেষ দৃশ্যে ওসামার সঙ্গে সহবাস শেষে গোসল করার জন্য চৌবাচ্চার গরম পানিতে (বিশেষভাবে নির্মিত এসব চৌবাচ্চার নীচে পানি গরম করার জন্য জ্বলন্ত চুলা থাকে) ডুব দেন বৃদ্ধ। চৌবাচ্চা থেকে উপচে পড়া পানিতে চুলা নিভে যায়, ধোঁয়ায় চারদিক ঝাপসা হয়ে আসে। বৃদ্ধের ‘‘পাক’’ শরীরের বিনিময়ে ধোঁয়ায় ডুবে যায় চারপাশ। প্রতীকের এমন ব্যবহারে বারমাক নির্মাতা হিসেবে শক্তিমান হন। তবে চলচ্চিত্রের রাজনীতিতে তিনি বিতর্কে পড়েন। কারণ এ ধোঁয়াশা আর দূর হয় না।
এটা ঠিক যে, ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তালেবান শাসনের পতন হলেও আফগানিস্তানের মানুষ এখনো মুক্ত হতে পারেনি। এখনো সেদেশে অবিরাম রক্ত ঝরছে। তার পরও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কি কোনো পরিবর্তন হয়নি? নিশ্চয় হয়েছে, জীবনের অনিশ্চয়তা হয়তো আছে, কিন্তু এটা নিশ্চিত বলা যায়, নারীরা অন্তত আগের সেই অবস্থায় নেই। তার মানে পরিবর্তন হয়, হয়েছে, আরো হবে। আর এর জন্য কেবল স্বপ্নটাকে এগিয়ে নিতে হয়। কিন্তু বারমাক সেটা পারেননি। তার পরও এই স্বপ্নহীন চলচ্চিত্র নিয়েই সিদ্দিক বারমাককে কেনো জানি সারাবিশ্বে নানা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এই রাজনীতিটা বোধ হয় ওসামা দেখার সময় দর্শকের মাথায় রাখা জরুরি।
আফগান দেশে একটা প্রবাদ আছে, ‘‘মুরগি না ডাকলেও রাত পোহায়।’’ বারমাক তার ওসামাতে ভোরের সূর্য দেখাতে নির্জীব থাকলেও, রাত পোহানো কিন্তু থেমে থাকেনি। এই ভোরে হয়তো অন্য কোনো বারমাক, অন্য ওসামা নিয়ে হাজির হবেন। যে ওসামা শুধু মুক্তির স্বপ্ন নয়, বাস্তবতাও ছোঁবে।
লেখক : রাশেদ রিন্টু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কম-এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত।
rashed.rin2@gmail.com
তথ্যসূত্র
১. সায়ীদ, বাহার; ‘‘জাতীয় বিপর্যয়’’; ভাষান্তর : রিপন মাহমুদ; মানুষ; সম্পাদনা : সেলিম রেজা নিউটন; সমাবেশ, ঢাকা, সংখ্যা ১, ফেব্রুয়ারি ২০০৩, পৃ. ১৭।
২. মাখমালবাফ, মোহসেন; ‘‘কী বলব পড়শির কথা, হস্ত-পদ-স্কন্দ-মাথা নাই রে ...’’; ভাষান্তর : বদরে মুনীর; মানুষ; সম্পাদনা : সেলিম রেজা নিউটন; সমাবেশ, ঢাকা, সংখ্যা ১, ফেব্রুয়ারি ২০০৩, পৃ. ৭০।
৩. https://en.wikipedia.org/wiki/Hafi“ullah_Amin#Amin.E2.80.93Taraki_break; retrieved on 28.05.2016
৪. http://www.sachalayatan.com/guest_writer/34622; retrieved on 28.05.2016
৫. প্রাগুক্ত; মাখমালবাফ (২০০৩ : ৭১)।
6. http://www.tricityvoice.com/articledisplay.php?a=2211; retrieved on 07.04.2016
7. http://www.tricityvoice.com/articledisplay.php?a=2211; retrieved on 07.04.2016
8. http://www.ntvbd.com/arts-and-literature/30671//print; retrieved on 03.04.2016
9. https://www.opendemocracy.net/arts-Film/article_1769.jsp; retrieved on 06.06.2016
10.http://https://www.opendemocracy.net/arts-Film/article_1769.jsp; retrieved on 06.06.2016
11. http://www.ntvbd.com/arts-and-literature/30671//print; retrieved on 13.04.2016
12. https://www.opendemocracy.net/arts-Film/article_1769.jsp; retrieved on 18.04.2016
13. https://www.opendemocracy.net/arts-Film/article_1769.jsp; retrieved on 21.04.2016
14. https://www.opendemocracy.net/arts-Film/article_1769.jsp; retrieved on 28.05.2016
মতামত
এই লেখায় মতামত দিতে লগ-ইন অথবা নিবন্ধন করুন ।