চলচ্চিত্রের বই » রঙধনুর চোখে ‘চলচ্চিত্র বিচার’
রঙধনুর চোখে ‘চলচ্চিত্র বিচার’
মূল্যায়ন, আলোচনা, ব্যাখ্যা—অন্যভাবে বললে সমালোচনা, এর কোনোটিরই নৈর্ব্যক্তিক কোনো অবস্থান নেই। ব্যক্তি মাত্রই তার অবস্থান থেকে সবকিছুর মূল্যায়ন করে। এই মূল্যায়ন কাউকে আনন্দ দেয়, কাউকে আহত করে। শিল্প-ইন্ডাস্ট্রি-প্রযুক্তির সমন্বিত মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এটা অপেক্ষাকৃত বেশিই ঘটে। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে একেবারে সাদাসিধেভাবেও কোনো কিছু নিয়ে বলা যায়। সেটা হয়তো অন্তর্দৃষ্টি নয়, হোক না বহির্দৃষ্টিই—তাতে কী! এ রকম একটা অবস্থান থেকে এ লেখার শুরু।
বাংলা ভাষায় যারা শিল্প-সাহিত্যের পূজারি, বিশেষত চলচ্চিত্র পাঠ করেন, তারা সংখ্যায় খুব একটা নন। যদিও সম্প্রতি প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কল্যাণে কিছু উঠতি চলচ্চিত্রপ্রেমী তৈরি হয়েছে—তবে সেটা চলচ্চিত্র প্রেম না ফ্যাশন, তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে। যদিও এটাই পুরো চিত্র নয়। এই অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে বিধান রিবেরুর লেখাপত্র চলচ্চিত্র পাঠের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে তা যে খুব বেশি পড়া হয়েছে এমনও নয়, তবে যে দু-চারখানা পড়েছি, তা থেকেই সাদাসিধে এ মন্তব্য করার সাহস করছি। কিন্তু লেখার বাইরে, তার সম্পর্কে খুব বেশি জানা হয়নি। তবে তার নামটা যখন থেকে জানি, কেনো জানি ভাবতাম বয়সে হয়তো বুড়োসুড়ো কেউ হবেন, যার অন্তত দু-চারটা দাঁত পড়ে গেছে! কিন্তু তার ‘চলচ্চিত্র বিচার’ বইটি হাতে পেয়ে সে ধারণা নিছকই কল্পনার বিভ্রম বলেই প্রতীয়মান হলো। বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা, ২০১১ খ্রিস্টাব্দে রিবেরুর লেখা প্রথম প্রবন্ধের বই ‘চলচ্চিত্র পাঠ সহায়িকা’ প্রকাশ হয়। লেখকের ছবি দেখে বয়সের ভ্রান্তিও কেটে গেলো; খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফের রিবেরু মাঝবয়সী এক কবিও!
এবার ‘চলচ্চিত্র বিচার’-এ ঢোকার পালা। সূচিতে থাকা ২৪টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে চার ভাগে। এর মধ্যে ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বিচার’ অধ্যায়ে প্রবন্ধের সংখ্যা আটটি। ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিচার’-এর সংখ্যাও একই। আর ছয়টি প্রবন্ধ ‘বিদেশী চলচ্চিত্র বিচার’ বিষয়ে, আর বাকি দুইটি ‘সংস্কৃতি কারখানা বিচার’ নিয়ে। প্রতিটি প্রবন্ধ গড়পড়তা চার-পাঁচ পৃষ্ঠার। একশো ২৮ পৃষ্ঠার এই বইয়ের প্রবন্ধগুলো ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ‘বুধবার’-এ প্রকাশিত।
প্রথম প্রবন্ধ ‘চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস’-এ ওরা ১১ জন থেকে গেরিলা পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রকৃত ইতিহাস বলতে লেখক ‘সত্য ও সামগ্রিক ইতিহাস’কে বুঝিয়েছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেই কেনো প্রকৃত ইতিহাস খুঁজতে হবে? কিংবা ‘প্রকৃত’ ইতিহাসইবা কী? নির্মাতার কাজ কি শুধু ইতিহাস রচনা করা? শুধু শিরোনাম দেখেই এসব প্রশ্ন মনে জাগে। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে সামগ্রিক ইতিহাস জানার আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহ দর্শকের আছে। এর মানে এই নয় যে, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র মানেই ‘প্রকৃত ইতিহাস’ভিত্তিক হতে হবে। আর এই ‘সত্য ও সামগ্রিক ইতিহাসে’রও যে এপিঠ-ওপিঠ বা রাজা-প্রজার নির্মাণ আছে তা স্পষ্ট হয় না এ প্রবন্ধে। ঐতিহাসিকের বয়ান নির্ভর করে তার সংস্কৃতি, অভিজ্ঞতার মাপকাঠিতে; আর এর বাইরে যেটা দেখা যায় না, সেটা হলো ফরাসি তাত্ত্বিক মিশেল ফুকোর ভাষায়—ক্ষমতা। ফুকো বলেন, যে ইতিহাস আমাদের ধারণ করে, আমাদের নির্ধারণ করে, সেটির আঙ্গিক ভাষার নয়, যুদ্ধের। এ বিষয়টিকে আমাদের ক্ষমতার সম্পর্কের সাহায্যে বুঝতে হবে, অর্থ সম্পর্কের সাহায্যে নয়।
তাই একজন ঐতিহাসিকের পক্ষে ‘প্রকৃত ইতিহাস’ তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব—যেখানে ভাষা বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি নয় বরং নির্মাতা। তবে ঐতিহাসিক ঘটনা যে কেউ তার সৃষ্টিতে তুলে আনতে চাইতেই পারেন। কিন্তু সেটা যে সামগ্রিক হতে হবে, এমন নয়। তাই মুক্তিযুদ্ধের সব চলচ্চিত্রে ‘সত্য ও সামগ্রিক ইতিহাস’ খোঁজাকে সমীচীন মনে হয়নি।
পরের প্রবন্ধ ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’-এ বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কিংবা বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক আলোচনা হয়েছে। ‘জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের শঙ্কাও আলোচনায় এসেছে। একই সঙ্গে আলোচনা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গানের ব্যবহারের বিষয়টিও। প্রবন্ধের শেষাংশে হুমায়ূন আহমেদকে শক্তিমান কাহিনিকার হিসেবে দেখানো হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানকে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে রোমান্টিকভাবে উপস্থাপনের জন্য। বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিটি দিকের মতো মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের এ উপস্থিতি বিধান রিবেরু খুব সচেতনভাবেই তুলে আনতে পেরেছেন তার এ প্রবন্ধে।
‘‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে বাংলার রূপ : সুলতানের অভাব’’ প্রবন্ধে আবহমান বাংলার চিত্র ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে চিত্রকলা আর চলচ্চিত্র মাধ্যমের তুলনামূলক সফলতা আলোচিত হয়েছে। চলচ্চিত্র ও চিত্রকলার মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করে লেখক বলেছেন, ‘... চিত্রকলা ও চলচ্চিত্রে দিনের পর দিন যেভাবে একইভাবে গ্রামবাংলার ছবি আঁকা হচ্ছে, পুনঃপুন উৎপাদিত হচ্ছে, তাতে বলা যায় চলচ্চিত্রের সুলতান হয়ে এখনো কেউ আসেনি।’’ আবহমান বাংলার প্রাণ-প্রকৃতির হয়ে উঠতে পারেননি আমাদের নির্মাতারা। রিবেরুর এ উপলব্ধি আসলেই ভেবে দেখার মতো। যে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যুদ্ধ, যে মানুষগুলোর জন্য দেশের অর্থনীতি আজও সজীব; মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে তাদের সেই মুক্তির কথা কোথায়?
লেখক ‘‘যুদ্ধ ও ভালোবাসার কাহিনি’ মেহেরজান-এর নির্মাতার বয়ানের সঙ্গে ‘‘আত্মদ্বান্দ্বিকতা’’ খুঁজে পেয়েছেন ‘‘মেহেরজান : যুদ্ধ ও হিংস্রতার বিরুদ্ধে নান্দনিক ব্যবস্থাপত্র!’’ প্রবন্ধে। পাশাপাশি মার্কস ও অ্যাঙ্গেলসের কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার উদ্ধৃত করে লেখক নির্মাতার কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিকতা দিয়ে দুনিয়ার কোনো বড়ো পরিবর্তন বা বিপ্লব হয়েছে কি না? চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে লেখকের ভাষ্য,
পুরো চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধকে সহায় করে চললেও কোথাও মুক্তি সংগ্রামের কোনো গান নেই, বরং আমরা শুনি উর্দু ভাষার এক প্রেমের গান। ... শুদ্ধ প্রেমের ছবিতে উর্দু গান বাজলে কেউ কিছু মনে করতেন না, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভ যেহেতু ধরা হয় ভাষা আন্দোলনকে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে বাঙালি মেয়ের বিচ্ছেদপর্বে উর্দু গান শোনানো কেমন যেন বালখিল্যে মনে হয় না, অপরাধ মনে হয়। চলচ্চিত্রটি দেখার ‘সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য’’ হয়নি। কিন্তু যতোটুকু পড়েছি-শুনেছি তাতে নির্মাতার পরিচিত গণ্ডিমুক্তির একটা রেশ টের পেয়েছি। তবে রিবেরুর এই প্রবন্ধ চলচ্চিত্রটির হিমায়িত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সত্যি চিন্তার জন্ম দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষকে লড়তে হয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে ‘‘গেরিলা : নারীর যুদ্ধ অতিক্রম’’ প্রবন্ধে। লেখকের মতে, গেরিলা চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েই যেনো ৪০ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকাকে একধরনের স্বীকৃতি দেওয়া হলো। পাশাপাশি লেখক পাকিস্তানি পার্টিতে বিলকিসের সেক্সসিম্বল উপস্থাপনের সমালোচনাও করেছেন শক্ত হাতেই। কিন্তু রিবেরুর এ প্রবন্ধের পঞ্চম অনুচ্ছেদের শুরুর কয়েকটি বাক্য প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘একাত্তরে এদেশের একদল মানুষ মনে করেছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের মতো পেশাদার সেনাবাহিনীর বিপক্ষে জয় সম্ভব নয়, তাই অনেকেই থেকেছেন নিষ্ক্রিয়, অনেকে আবার যোগ দেন পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্যাদি তকমা নিয়ে।’’ এখানেই আপত্তি; রিবেরু যদি সত্যিই মনে করেন বিজয় সম্ভব নয়—তাই অনেকে রাজাকার, আলবদর, আলশামস গঠন করে পাক সেনাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, তবে বলবো রিবেরুর বোঝাপড়ায় ভিন্নতা আছে। কেননা এটা পরিষ্কার যে, এই রাজাকার, আলবদর, আলশামস শুধু যুদ্ধে হেরে যাওয়ার ভয়ে হয়নি, বরং এর পিছনে তাদের শক্ত মতাদর্শ ছিলো, ছিলো ভিন্ন স্বার্থ, ক্ষমতার লোভ। যে জন্য স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে তারা হত্যা করেছে কৃতি সন্তানদের। নয়টি মাস জুড়ে জীবন দিতে হয়েছে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে, সম্ভ্রম হারিয়েছেন অনেক নারী। এগুলো কি কেবলই হেরে যাওয়ার ভয়!
পুরুষতান্ত্রিকতার হুকুমজারির অভিযোগ আনা হয়েছে ‘স্বাধীনতার চল্লিশতম বর্ষে তিন নারী : মেহেরজান, অরু ও বিলকিস’ প্রবন্ধে। মেহেরজান, গেরিলা ও আমার বন্ধু রাশেদ—এই তিনটি চলচ্চিত্রের তিন নারীচরিত্র নিয়ে আলোচনা হয়েছে এখানে। প্রবন্ধে রিবেরু যে সৎ ও অসৎ নির্মাতার কথা বলেছেন, তাদের দুই পক্ষই তার মতে স্বাধীনতা যুদ্ধকে প্রকৃত উপস্থাপনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রবন্ধের শেষাংশে মুক্তিযুদ্ধে অবাঙালি যোদ্ধার অংশগ্রহণের বিষয় এড়িয়ে যাওয়া নিয়ে লেখকের আক্ষেপ প্রকাশ পেয়েছে। তার ভাষায়, ‘‘গারো, চাকমা, সাঁওতালসহ কত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষও তো ১৯৭১ সালে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন যুদ্ধে। কিন্তু তাঁদের কথা ভুলেও কেউ উচ্চারণ করেন নি গেল চল্লিশ বছরে। চলচ্চিত্রে তো নয়ই, গল্প উপন্যাসেও নয়।’ শেষ অনুচ্ছেদের এ বক্তব্যটি আরো বিস্তৃত হওয়া জরুরি। কেননা যে জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে আদিবাসীদের আজ দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, সেই জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় যে তাদেরও অবদান আছে তা আরো বিস্তৃত পরিসরে উঠে আসা উচিত।
পূর্ব পাকিস্তানিদের মতো শোষিত হওয়ার অভিজ্ঞতা আলজেরিয়দেরও। ফরাসি উপনিবেশ থেকে তারা বিচ্ছেদ চেয়েছিলো, মুক্তির নিশান ছিলো হৃদয়জুড়ে। আলজেরিয়দের বিচ্ছেদ ঠেকাতে আপ্রাণ ও নিষ্ঠুর চেষ্টা করে ফরাসি প্রভুরা। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে বিদেশি শাসন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি মেলে আলজেরিয়দের। বঞ্চনা-শোষণের হাত থেকে মুক্তির এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জিলো পন্টিকর্ভো নির্মাণ করেন ব্যাটল অব আলজিয়ার্স। এটি আধুনিক রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। চলচ্চিত্রটি দর্শককে পর্দার সঙ্গে এমনভাবে গেঁথে ফেলে যে একবারও একঘেয়ে কিংবা বিরক্ত লাগে না বলে লেখক মন্তব্য করেন ‘‘কালজয়ী রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের আকাঙ্ক্ষা অথবা ‘‘ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’’ প্রবন্ধে। তার মতে, ‘‘বিষয়ের অংশ হয়ে যায় দর্শক। পুরো ছবিতে কোথাও অনর্থক ভাঁড়ামি ও সুড়সুড়ি দেয়ার জন্য নারীদেহের অবমাননা নেই। আফসোস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে সেসবও দেখতে হয়েছে দর্শকদের।’’ কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সব চলচ্চিত্রই যে নারীদেহের অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত তাও কিন্তু নয়। ব্যাটল অব আলজিয়ার্স-এ নারীর যে মূল্যায়ন, ততোটা শক্তিশালী না হলেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও (হাঙর নদী গ্রেনেড, আগুনের পরশমণি, রাবেয়া, গেরিলা, জয়যাত্রা) এ ধরনের উদাহরণ আছে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বিচার বিভাগের সর্বশেষ প্রবন্ধ চলচ্চিত্রে বাস্তববাদ নিয়ে। ‘‘চলচ্চিত্র য(ক)খন জীবনঘনিষ্ঠ’’ শীর্ষক এ প্রবন্ধে ভিত্তোরিও ডি সিকার দ্য বাইসাইকেল থিভস্, টু উইমেন ও জ্যঁ রেঁনোয়া’র টনি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রিবেরুর ভাষ্য, ‘‘বাস্তববাদী নন্দনতত্ত্বের নির্মাতারা চেষ্টাই করেছেন সমাজের রুঢ় বাস্তবতাকে তুলে ধরতে, তারা চেয়েছেন সেই বাস্তবতা যেন দর্শককে ভাবিয়ে তোলে। ... জীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখে তুলে ধরেছেন তাঁদের সেলুলয়েডে।’ আর এ আশা তো করতেই পারি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রও একদিন তেমনই বাস্তবতা তুলে আনবে, যা বর্তমান প্রজন্মকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।
‘‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিচার’’ বিভাগের প্রথম প্রবন্ধটি ‘‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : তিনের হাতে বন্দি’’ শিরোনামে। এ দেশে দর্শকের ভালো চলচ্চিত্র দেখার অধিকার আদায় হয়নি। ফলে হয় প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে নিম্নমানের চলচ্চিত্র দেখো অথবা বাসায় বসে অন্য দেশের আগ্রাসনের শিকার হও অথবা শপিং মলে শপিং করো—বিনোদনের জন্য এই তিন ব্যবস্থাই তো যথেষ্ট! ‘‘চলচ্চিত্রের বন্দিত্ব’ শিরোনামের এই প্রবন্ধ সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণ, বিতরণ, বোঝাপড়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পেরেছে। এছাড়া ঢাকাই চলচ্চিত্রনির্মাতা ও প্রযোজকের দুটো বড়ো দুর্বলতার একটি হচ্ছে, চলচ্চিত্র যে শুধুই মুনাফার হাতিয়ার নয়, শিল্পও—বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া। অন্যটি হচ্ছে শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব, মানে চলচ্চিত্র ব্যাকরণ সম্পর্কে অসচেতন থাকা। এই দুই দুর্বলতার কথা নানান আঙ্গিকে প্রকাশ পেয়েছে ‘‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : ভেতরকার দুই সঙ্কট’’ প্রবন্ধে। পরের প্রবন্ধে ভোগবাদীতার আধেয় থেকে বেরিয়ে দেশের চলচ্চিত্রকে সাধারণ মানুষের সত্যিকার জীবন যাপনের আখ্যান রূপে প্রত্যাশা করেছেন লেখক। ‘‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : নতুন কিছুর অপেক্ষায়’’ শিরোনামের প্রবন্ধে টেলিভিশনের চ্যালেঞ্জকে স্বীকার করেই লেখক চলচ্চিত্র অঙ্গনে সরকারি উদ্যোগ ও ‘‘পেশাদার’ প্রযোজকের পাশাপাশি শিক্ষিত-প্রতিভাবান নির্মাতার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন। যা বর্তমান বাংলাদেশি ইন্ডাস্ট্রির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে অন্যের জীবন যাপন পালটে দেওয়ার স্বপ্ন দেখায়—এমন চলচ্চিত্রের ঝক্কি আছে। কিন্তু তাতে রক্ষা হয় শিল্পীর স্বাধীনতা। অন্যরা নিজের স্বাধীনতা বিক্রির নামে যেটা করছে সেটাকে ‘‘স্বাধীনতা ব্যবসায়’’ ছাড়া দ্বিতীয় কী নামে ডাকবেন? লেখক এ প্রশ্ন ছুড়েছেন ‘‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : প্রকৃত গণমানুষের হওয়া উচিৎ’ শিরোনামের লেখায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা বলে, সাম্রাজ্যবাদীদের নানান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলে, আমজনতার চোখের পর্দা খুলে ভাবনার জগতকে উসকে দেয়—এমন চলচ্চিত্র আন্দোলন জরুরি বোধ করেন লেখক ‘‘ভালো চলচ্চিত্র : ভালোর মানচিত্র বানায় কে’’ প্রবন্ধে। তার মত, বুর্জোয়াদের কাছে চলচ্চিত্র নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বুঁদ করে রাখার একটি ভালো ব্যবসায়িক পণ্য। কিন্তু আমাদের কাছে চলচ্চিত্র এক মোক্ষম অস্ত্র, বুর্জোয়া মানসিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর। প্রবন্ধ দুটিতে লেখক ভালোভাবেই বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, গণমানুষের জন্য, গণমানুষকে নিয়ে চলচ্চিত্র না হলে শিল্প (কলা) ও শিল্প (ইন্ডাস্ট্রি) কোনোটাই দাঁড়াবে না। আর ভালো চলচ্চিত্রের মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন যুগোপযোগী। আর মান নিয়ে সংশয় তো আছেই।
ঢাকাই চলচ্চিত্রে কাদের কথা বলা হয় আর কাদের বাদ দেওয়া হয়—এমন প্রশ্ন তুলে বিধান রিবেরু বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন ‘‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : সাবলটার্নদের কথা কি বলে’ প্রবন্ধে। তার ব্যাখ্যা এমন—‘‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ... গরিব মানুষ আছে কিন্তু আখেরে তারা উচ্চবর্গের ভাষ্যে পরিণত হয়। সেখানে তারা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে অপারগ।’’ আসলেও রাষ্ট্রযন্ত্রের অনুশাসন ভেঙে নিম্নবর্গের চৈতন্য জাগানো চলচ্চিত্রের জন্য যে আর কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে, তা হয়তো কারও জানা নেই।
মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে টুপি-দাড়ি রাখা মৌলবিকে রাজাকার চরিত্র হিসেবে সবসময় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্যতিক্রম শুধু হুমায়ূন আহমেদ। সেই স্টেরিওটাইপ ভেঙে চলচ্চিত্রে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরানো দেখান তিনি। শ্যামল ছায়ার এই বিষয়টি ছাড়াও হুমায়ূনের আগুনের পরশমণিতে রবীন্দ্রনাথের গানের অসাধারণ ব্যবহারে মুগ্ধ লেখক। রিবেরু ‘‘হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র : নতুন কি বলেছেন’’ প্রবন্ধে উপন্যাসের ক্ষেত্রে তার বলার ধরন আর চলচ্চিত্রে তার বক্তব্যকে (মানে যা বলছেন) অধিকতর আকর্ষণীয় বলে মূল্যায়ন করেছেন। ‘চলচ্চিত্র বিচার’’ বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষ লেখা প্রয়াত তারেক মাসুদকে নিয়ে ‘‘তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র যাত্রা : যে রানওয়েতে নামলো’’ শিরোনামে। প্রবন্ধে তারেকের চলচ্চিত্রিক ও কারিগরি জ্ঞানের পাশাপাশি রানওয়েতে তার পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। তাত্ত্বিক ভিত্তিসহ এই আলোচনাটিও দাঁড়িয়েছে ভালোই।
রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ অবলম্বনে সত্যজিতের তিন কন্যার এক কন্যার বিনির্মাণের আলোচনা দিয়ে তৃতীয় অধ্যায় ‘‘বিদেশী চলচ্চিত্র বিচার’’-এর শুরু। পরের প্রবন্ধটিও উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র বিনির্মাণের। ‘পথের পাঁচালী : বিভূতিভূষণ থেকে সত্যজিৎ’ শিরোনামে এ প্রবন্ধে লেখকের ভাষায় ‘‘একজন পুনর্বার বাঙালির মননে সার্থকভাবে এঁকেছেন প্রকৃতি আর মানুষের জড়াজড়ি সম্পর্ককে, অন্যজন বাঙালির গ্রামীণ জীবনকে মুন্সিয়ানা নিয়ে মূর্ত করেছেন, পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্ব দরবারে।’ পরের প্রবন্ধ দুইটি চলচ্চিত্রে প্রতীক ব্যবহারে অসাধারণ প্রতিভা দেখানো ঋত্বিক ঘটকের সৃষ্টি নিয়ে। বিভাগের শেষের আগের লেখা গৌতম ঘোষের মনের মানুষ নিয়ে। লালনকে পণ্যকরণের অভিযোগ তুলে লেখক বলেছেন, প্রান্তিক মানুষের সম্রাট লালনকে, সাধনার গোপনীয়তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, যৌনতার মোড়কে যেভাবে তারা উপস্থাপন করেছেন, তাতে লালন পরিণত হয়েছেন পণ্যে, যেভাবে নারীরাও এখানে পণ্য হিসেবে উপস্থাপিত।
এই অধ্যায়ের শেষ প্রবন্ধ ‘‘রবিন হুড : ক্রুসেড ও জাতীয়তাবাদ’’-এ রবিন হুডকে ইংলিশ জাতীয়তাবাদের কাণ্ডারি রূপে পরিবেশনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তাকে জাতীয়তাবাদের ক্যানভাসার বানিয়ে জ্ঞান উৎপাদনের উদ্দেশ্য নিয়েও। এ বিভাগের লেখাগুলো আকারে ছোটো হলেও বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। সঙ্গে যুক্তি দিতেও কার্পণ্য নেই লেখকের। তাই বিচারের ক্ষেত্রে উতরে গেছে প্রবন্ধগুলো।
‘‘সংস্কৃতি কারখানা বিচার’’ এই গ্রন্থের শেষ অধ্যায়। জার্মান চিন্তাবিদ ম্যাক্স হর্কহেইমার ও থিয়োডর অ্যাডর্নো’র সংস্কৃতি কারখানা তত্ত্বে শাহরুখ, মালাইকাদের আধিপত্য, হরদম বিচরণ ও ব্যবসা বিশ্লেষণের চেষ্টা ‘‘হোক বিজয় বা ভাষার মাস : শাহরুখ মালাইকা খাচ্ছি সবাই : বারো মাস’’ প্রবন্ধের বিষয়। প্রতিবেশী দেশের ভাষার যে আক্রমণ, তা নগ্ন রূপ লাভ করেছে আদতেই। কেউ বলতে পারেন, ভাষা তো কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের অন্যতম মাধ্যম কিন্তু এই ভাষাই। সেদিক থেকে রিবেরুর এ প্রবন্ধ মতাদর্শিক আধিপত্য রোখার তর্কে শক্তি জোগাবে। লেখকের মতে, বিজয় বা ভাষার মাস হলেও চাহিদা ও চেতনা সম্পর্কে উৎপাদনকারীরা বেশ ওয়াকিবহাল। ফলে সংস্কৃতি কারখানা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে একের পর এক বাস্তববিমুখ চটকদার পণ্য। বইয়ের সর্বশেষ লেখাটিও সংস্কৃতি কারখানা বিচারের আওতায়। বলিউডের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে দৈনন্দিন জীবন কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে, সরাসরি তারই সাদামাটা বিশ্লেষণ ‘‘ইতর থেকে সামান্য : ভারতীয় নাচাগানা অগ্রগণ্য’’ প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন লেখক। বলিউড জ্বরের বর্ণনা রিবেরুর ভাষায়, ‘‘চিন্তার মধ্যে এমনভাবে বাসা গাড়ছে যে আপনার মনে হবে চোস্ত বিনোদন মানে হিন্দি সিনেমা, মন সজীব করা বিনোদন মানে হিন্দি চলচ্চিত্রের গান, যে গানের সঙ্গে থাকে অ্যাক্সোটিক, ইরোটিক ব্যাপারস্যাপার।’’ মানবীয় সম্পর্ককে বিজ্ঞাপনে চটকদার উপস্থাপন আর নারীর পণ্যকরণের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের নদীতে ভারতীয় জোয়ারের প্রবল প্রতাপের যে কথা লেখক বলেছেন তা আদতেই রোখা কঠিন।
একটা বিষয় বলা জরুরি মনে করছি, রিবেরু হয়তো সচেতনভাবেই তার প্রায় প্রতিটি প্রবন্ধেই একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। যা বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক তুলনা বুঝতে সহায়তা করেছে; পাঠককে আলোচনার ভিত্তি দিয়েছে। তবে ২৪টি প্রবন্ধ পাঠে অনেক বিষয়ই ঠিক পরিষ্কার হয়ে ওঠেনি। অন্ততপক্ষে আরো সহজ, সরল, প্রাঞ্জল ভাষায় কথাগুলো বলা যেতো। এর মানে এই নয় যে, রিবেরু খুব দুর্বোধ্য ভাষায় লিখেছেন। বোধ করি, আরো সহজ হলে চলচ্চিত্র পাঠের যে কম সংখ্যক লোকের কথা শুরুতে বলেছিলাম, তা বাড়তে পারতো।
লেখক : বিধান রিবেরু
প্রকাশক : মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন
প্রথম প্রকাশ : একুশে বইমেলা ২০১৪
প্রচ্ছদ : আকরাম রতন
মূল্য : ১৬০ টাকা
লেখক : রোকন রাকিব, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছেন।
rakib.2071@gmail.com
মতামত
এই লেখায় মতামত দিতে লগ-ইন অথবা নিবন্ধন করুন ।